‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আমাদের মাথা হেঁট হয়েছে’

নাগরিক সহিংসতার প্রতিবাদে সমাবেশ। বুধবার রাজধানীর শাহবাগে
ছবি: প্রথম আলো।

কোনো রাষ্ট্রে ধর্মের পরিচয়কে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করা হলে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তা এখনো পূরণ হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতার নানা অপব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক দলগুলোর নানা রকম আপসের কারণে মানুষের মনস্তত্ত্বে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এ কারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটছে। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে হলে সেই মনস্তত্ত্বের জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে।

বুধবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা যৌথভাবে এ কর্মসূচির আয়োজন করেন। এ কর্মসূচি থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরশাসনবিরোধী আট দফা দাবি জানানো হয়৷

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। এই বাংলাদেশ দেখার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ধারায় বাংলাদেশকে ফেরাতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হিন্দুধর্মাবলম্বী ভাইবোনদের কাছে আমি করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। তাঁরা এবার নির্বিঘ্নে তাঁদের পূজা করতে পারেননি। রাষ্ট্র তাঁদের উৎসবের নিরাপত্তা দিতে পারেনি।’

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সদস্য ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও তা বিশ্বাস ও ধারণ করে না। তারা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ব্যবসা করে।’ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

বিভিন্ন সময়ের শাসক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে অভিযোগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ। তিনি বলেন, ‘পরিচয়কে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করা হলে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা হলে বা ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হলে কোনোমতেই রাষ্ট্রে শান্তি স্থাপন সম্ভব নয়।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে শারদীয় দুর্গোৎসব যেভাবে কলঙ্কিত হয়েছে, তাতে শুধু লজ্জা-ক্ষোভ নয়, জাতি হিসেবে সারা দুনিয়ার কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।’ দুর্গোৎসবে নিরাপত্তা দিতে না পারায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোকে বর্তমান সরকার সব সময়ই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ করেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। তিনি বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে সংস্কৃতি খাতে বাজেট কমেছে। অথচ মৌলবাদী শক্তিগুলোকে বিভিন্নভাবে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অবিলম্বে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর বিচার করতে হবে।’

এ কর্মসূচি থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরশাসনবিরোধী আট দফা দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত ও মদদদাতাদের গ্রেপ্তার ও বিচার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অপসারণ, সভা-সমাবেশ ও ইউটিউব-ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা, আগের সব সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার ও সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর ঘটনা তদন্তে ‘গণতদন্ত কমিটি’ গঠন, সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি।

সমাবেশে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, আবদুর রাজ্জাক খান, জোবাইদা নাসরীন প্রমুখ। সমাবেশ শেষে সন্ধ্যায় একটি মশাল মিছিল বের করা হয়।