সাহস বাড়াতে তায়কোয়ান্দো

ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতন বাড়ায় মার্শাল আর্ট শেখার গুরুত্ব বাড়ছে। সারা দেশে মার্শাল আর্টের চর্চা বাড়ানোর জোর দিয়েছেন অনেকে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর তায়কোয়ান্দো ক্লাবে মেয়েরা শিখছে আত্মরক্ষার নানা কৌশল।
সম্প্রতি তোলা ছবি : প্রথম আলো

মরিয়ম আর আয়েশা দুই বোন। মরিয়ম বুয়েটে পড়ছেন। আর আয়েশা এবার এইচএসসি পাস করেছেন। রাজধানীর শেখেরটেকে বাসা তাঁদের। সপ্তাহখানেক হলো দুই বোন মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের কাছে একটি ক্লাবে তায়কোয়ান্দো শিখছেন।

তায়কোয়ান্দোর ক্লাস শেষে জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে মরিয়ম বললেন, ‘বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশলটি শিখে রাখা জরুরি।’

ক্লাবে গিয়ে দেখা গেল, ছেলেমেয়েরা যখন ক্লাস করে, অভিভাবকদের অনেকেই তখন বসে থাকেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি। কয়েকজন অভিভাবক বললেন, তায়কোয়ান্দো শিখলে একদিকে বাচ্চাদের শারীরিক গঠন ঠিক থাকবে; ইউটিউব, মুঠোফোন থেকে দূরে রাখা যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, পথেঘাটে যদি বিপদে পড়ে, তাহলে অন্তত বাঁচার চেষ্টা করতে পারবে।

বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী সদস্য মাহমুদুল ইসলাম জানালেন, সাম্প্রতিক সময়ে অভিভাবকদের, বিশেষ করে মেয়েসন্তানের বাবা-মায়েদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন বয়সী মেয়েরাও তায়কোয়ান্দো শিখতে চায় বলে ফোনে জানাচ্ছে।

তায়কোয়ান্দোতে বিপদ থেকে দূরে থাকার জন্য বুদ্ধি, বিবেচনা, কৌশল শিখিয়ে দেওয়া হয়। আর শারীরিকভাবে যদি হামলা করেই ফেলে, তখন অপরাধীকে শরীরের কোন জায়গায় আঘাত করলে সহজে কাবু করা যাবে, তা শিখিয়ে দেওয়া হয়।

অবশ্য অভিভাবক এবং নারী ও শিশু অধিকারকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আত্মরক্ষার কৌশলকে ধর্ষণের মতো অপরাধ বন্ধে সমাধান মনে করা যাবে না। এর জন্য দরকার দোষীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা। দেশে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করে সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশে জারি হয়েছে।

তায়কোয়ান্দো, উশু, জুডোসহ বিভিন্ন ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, বিভিন্ন আত্মরক্ষার কৌশলে শৃঙ্খলা, শারীরিক সুস্থতা, আত্মবিশ্বাস ও সুরক্ষা—চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নারী-শিশু ধর্ষণ, পথেঘাটে যৌন হয়রানি বাড়ায় নিজের কন্যাসন্তানকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে অভিভাবকদের। অনেক সংস্থা অনলাইনে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সেখানেও আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ছে।

মোহাম্মদপুরের নবম ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়ের মা শাহিনূর আক্তার জানালেন, তাঁর দুই মেয়ে তায়কোয়ান্দো শিখেছে (রেড বেল্ট পেয়েছে)। মেয়েদের সাইকেল চালানো শিখিয়েছেন। দুই মেয়ে অভিভাবক ছাড়াই স্কুলে যায়। শাহিনূর আক্তারের মতে, তায়কোয়ান্দো শিখেছে বলে মেয়েদের মধ্যে খানিকটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, ওদের একা চলতে হবে, এ খারাপ সমাজেই টিকে থাকতে হবে, সে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই তাদের একা ছাড়া হচ্ছে। পথেঘাটে বিপদে পড়লে, তা মোকাবিলার চেষ্টাটা অন্তত করতে পারবে।

মার্শাল আর্ট শিখলে সাহসটা বাড়বেই। আমি পথেঘাটে চলতে কখনো ভয় পাইনি। বিপদ এলেও তা থেকে বের হতে পেরেছি।
কামরুন নাহার, পরিচালক (স্পোর্টস), দক্ষিণ এশিয়ান জুডো ফেডারেশন

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন বলছে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর—এই ৯ মাসে প্রতিদিন গড়ে তিনটির বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৯ মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৭৫টি। ৯ মাসে ধর্ষণের পর ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আর আত্মহত্যা করেছেন আরও ১২ জন নারী। গত বছর একই সময়ে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ১ হাজার ১১৫টি। ওই সময়ে ৫৭ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। অর্থাৎ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলছে।

দক্ষিণ এশিয়ান জুডো ফেডারেশনের পরিচালক (স্পোর্টস) কামরুন নাহার বললেন, ‘মার্শাল আর্ট শিখলে সাহসটা বাড়বেই। আমি পথেঘাটে চলতে কখনো ভয় পাইনি। বিপদ এলেও তা থেকে বের হতে পেরেছি। তবে মার্শাল আর্টকে যে পর্যায়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, তা দেওয়া হচ্ছে না এখনো।’

২০১৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ বৈশ্বিক প্রচারাভিযান শুরু করেছে। একশনএইডের তখনকার এক গবেষণা বলছে, নগরের ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী গণপরিবহন, রাস্তা বা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের ৮৮ শতাংশই বলেন, তাঁরা পথচারী, পুরুষ যাত্রী ও ক্রেতাদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন।

একশনএইড বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক ফারাহ্ কবির বললেন, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মতো বিষয়ে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাকে রোগের ওষুধ বলা যাবে না। মার্শাল আর্ট বা আত্মরক্ষার কৌশলকে একটি হাতিয়ার বলা যায়। ফারাহ্ কবির জানালেন, তাঁর অফিসের কর্মীদেরও আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হয়েছে। তাঁর মতে, এখানে যাঁরা, বিশেষ করে যে নারীরা কাজ করেন, তাঁরাও তো পথেঘাটে একই ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।