সেই ১১ দফাতেই ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়া’

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ওই আন্দোলনে যে ৯টি দাবি জানানো হয়েছিল সেখানে বাসে অর্ধেখ ভাড়ার বিষয়টিও ছিল।
সংগৃহীত

হাফ বা অর্ধেক ভাড়া নিয়ে আন্দোলনটা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ারও আগের। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর, এরপর সরকার বদলেছে অনেকবার। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে চূড়ান্ত কোনো আইন কিংবা সিদ্ধান্ত—কোনোটাই আসেনি।
ফলে স্বাধীনতার পূর্বে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে এখনো। গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

ইতিহাসে নজর রাখা যাক। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাত ধরে আসে ১১ দফা দাবি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (রাশেদ খান মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (বেগম মতিয়া চৌধুরী), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) আটজন ছাত্রনেতা সম্মিলিতভাবে গঠন করেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।

পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এ ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা। দাবির ১ (ঢ) দফা অনুসারে, ‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের “আইডেন্টিটি কার্ড” দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ “কন্সেসনে” (ছাড়ে) টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও “কন্সেসন” দিতে হইবে।’

আজ রোববারও অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।
প্রথম আলো

বাসভাড়া সম্পর্কে ধারাটিতে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যেকোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ “কন্সেসন” (ছাড়) দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ “কন্সেসন” দিতে হইবে।’

তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, তখন আমাদের আন্দোলনের পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদেশে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন হয়। অবশ্য এটা আইনে দ্বারা হয়নি। এই ধারা স্বাধীনতার পরও বহু বছর চালু ছিল। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে অর্ধেক ভাড়ার বিষয়টি নেই। তিনি বলেন, এটা থাকা উচিত। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এতো ভাড়া দেওয়া সম্ভব না। তা ছাড়া হাঁটার পরিবেশ ঢাকা শহরে নেই। হাফ ভাটার বিষয়টি উঠে যাওয়া উচিত হয়নি।

তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলনের পর তখনকার শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে দিতেন অর্ধেক ভাড়া।

‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন যাত্রীদের অধিকার নিয়েও কাজ করেন তিনি। ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আমরা হাফ ভাড়া দিতাম। তখন ঝগড়া হতো না। আইডি কার্ড দেখালেই হাফ ভাড়া নিত। তখন ছাত্র বললেই হাফ ভাড়া হতো।’

কিন্তু স্বাধীনতার পর সাম্প্রতিক কয়েক বছর অর্ধেক ভাড়া ঢাকার রাস্তায় দেখা যায় শিক্ষার্থী ও বাসচালকের সহকারীর তর্ক, হাতাহাতি।

সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় আন্দোলনগুলোর একটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন—২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি। তখন ঢাকা অবরোধ করা শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির ভেতরে অন্যতম ছিল, ‘শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

এরই মধ্যে চলতি মাসে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। বর্ধিত ভাড়ার মধ্যে কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা দাবি জানাচ্ছে তাঁদের জন্য অর্ধেক ভাড়া চালুর। আজ রোববারও ঢাকার সায়েন্সল্যাব, ফার্মগেটে এ দাবিতে বাস ভাঙচুর করেছে শিক্ষার্থীরা। তবুও নীরব সরকার।

হাফ পাশ নেই—লেখা মুছে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
প্রথম আলো

সিদ্ধান্ত নেবে কে

শিক্ষার্থীদের নয় দিন ধরে চলা ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর প্রণয়ন হয় সড়ক পরিবহন আইন। কিন্তু সেখানেও ৯ দফা একটি অর্ধেক ভাড়াসংক্রান্ত দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে।

এরপর নভেম্বরের শুরুতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে অঘোষিত ধর্মঘট পালন শুরু করেন বাস, ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহনের মালিকেরা। বাসভাড়া নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বৈঠক করে পরিবহনমালিকদের সঙ্গে ৭ নভেম্বর। নতুন বর্ধিত ভাড়াও নির্ধারিত হয়। সেখানেও শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছে বিআরটিএ সূত্র।

যদিও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন কয়েকবার। ২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসির কার্যালয়ে বাস ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এক বৈঠকে আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নির্দেশনার পর ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নিয়ে পরিবহনমালিকদের কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাংসদ মশিউর রহমানকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘(ওবায়দুল কাদেররের) এমন কথার পর আমাদের সঙ্গে তাঁর এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিআরটিসি অর্ধেক ভাড়া চালু করতে পারে।’

পরিবহনমালিকেরা কোনো উদ্যোগ নিবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, ‘এটা সরকারের বিষয়। আমাদের নয়। আমাদের না বললে যেঁচে গিয়ে সরকারের সঙ্গে বসব না। সরকার বলুক।’

বাস্তবতা হচ্ছে, আইনগত ভিত্তি না থাকায় ওবায়দুল কাদেরের সে নির্দেশনা মানছেন না বেশির ভাগ গণপরিবহনমালিকেরা। ফলে অভিযান চলাকালে বাসে চলাচলকারী শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের মুখে পড়ছেন খোদ বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটরাই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর একজন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইনে হাফ ভাড়ার প্রবিশন নেই। তাই আমাদের কাছে (শিক্ষার্থীরা) বললে আমাদের চুপ থাকতে হচ্ছে।’

শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়া দিতে দিতে বিষয়টি প্রথা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু বাসমালিকেরা অর্ধেক ভাড়া নিতে চান না। বাসের ভেতর অনেক সময় অসদাচরণের অভিযোগও পাওয়া যায় অহরহ। মশিউর রহমান বলেন, ‘অর্ধেক ভাড়া নিয়ে আন্দোলন করলে হবে না। বরং তখন গাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। আমার ব্যবসা না চললে আমি বন্ধ করে দিব।’

যাত্রীদের অধিকার কাজ করা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, উন্নত অনেক দেশেই ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া রাখা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এটা নিয়ে ঝগড়া একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। হাফ পাশ দেওয়া হোক বা না হোক—তা একটা সিস্টেমে আনতে হবে।

ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, সরকার এটা (অর্ধেক ভাড়া) দিতে পারে। মালিক কেন দেবেন? স্কুল কর্তৃপক্ষও দিতে পারে। এটা নিয়ে ঝগড়ার কোনো কারণ নেই। কারা ভর্তুকি দেবে, সেটা তাঁরা জানেন।