স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার স্বেচ্ছাচারিতা

এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসিয়ে ভাড়াটে ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ আদায় করছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। ছবিটি মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো
এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসিয়ে ভাড়াটে ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ আদায় করছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। ছবিটি মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো

সমাজসেবার নামে মহাখালী ওয়্যারলেস গেট এবং এর আশপাশের এলাকায় ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। এখন সেই সিসি ক্যামেরা রক্ষণাবেক্ষণের নামে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দোকানপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ এবং ফ্ল্যাটপ্রতি ১০০ টাকা করে প্রতি মাসে চাঁদা দিতে হবে। রীতিমতো ছাপানো রসিদের মাধ্যমে সে টাকা চাওয়া হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার ওয়্যারলেস গেট, হাজারিবাড়ি, স্কুল রোড, জিপি-গ ও জিপি-চ এলাকার অন্তত ২০ জন দোকানদার ও বাড়ির বাসিন্দার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। ব্যবসায়ীরা বলেন, এলাকায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে প্রায় দুই মাস আগে। এত দিন টাকা চাওয়া হয়নি। গত সোমবার তাঁদের দোকানে দোকানে একটি করে মাসিক চাঁদার রসিদ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা এখনো চাঁদার পরিমাণ এবং চাঁদা দেবেন কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা কয়েকটি চাঁদার রসিদ পরীক্ষা করে দেখা যায়, সাদা রঙের কাগজে, নীল কালির হরফে ওপরে লেখা রয়েছে ‘সিসি ক্যামেরা এন্ড সিকিউরিটি সার্ভিস, জিপি-গ এবং জিপি-চ হোল্ডিংয়ের মেইনটেনেন্স চার্জ’। নিচে প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, মেইনটেন্যান্স চার্জের পরিমাণ এবং মাসের নাম লেখা।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দিন আগে সিসি ক্যামেরার দায়িত্বে থাকা লোকজন দোকানে ঢুকে মালামালের পরিমাণ, দোকানের আকৃতি কেমন তা পরীক্ষা করেন। দোকান বড় আকৃতির হলে এবং মালামাল বেশি থাকলে তাদের চাঁদা ৫০০ টাকা ধরা হয়েছে। প্রিন্টিং প্রেস, জুয়েলারি দোকান, স্যানিটারি দোকানগুলোর ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ধরা হয়েছে। আর ছোট দোকান এবং মালামাল কম এমন দোকানের চাঁদা ৩০০ টাকা।

এমনই রসিদ কেটে সার্ভিস চার্জ আদায় করা হচ্ছে
এমনই রসিদ কেটে সার্ভিস চার্জ আদায় করা হচ্ছে

ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাঁদার টাকার বিষয়ে কথা বলা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্কুল রোডের একজন দোকানির সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলেন। কথা শেষে দোকান থেকে বের হয়ে আসার সময় তিনি তাঁর নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ‘আপনি আমার দোকানে কথা বলছেন, সেটাও ক্যামেরায় ধরা পড়ছে। তাতেও আমার ঝামেলা হবে।’ ওয়্যারলেস গেট এলাকার একজন দোকানদারের কাছে চাঁদার রসিদ দেখতে চাইলে তিনি রসিদ বের করে দেন। কিন্তু রসিদের ছবি তুলতে চাইলে রসিদে থাকা নিজের নাম কেটে দেন। তিনি বলেন, ‘বুঝেনই তো, এলাকায় ব্যবসা করে চলতে হয়। যারা টাকা চাইছে, তারাই এলাকা চালায়। জানলে সমস্যা করবে।’
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি সড়কের কোনায় এবং কিছু বাড়ির দেয়ালে সাদা রঙের ছোট আকৃতির সিসি ক্যামেরা লাগানো। এসব ক্যামেরার পাশে লাল কালিতে ‘সাবধান, অত্র এলাকা সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’ লেখা ছোট আকৃতির সাইনবোর্ড টাঙানো।
ওয়্যারলেস গেট মোড়ে একটি দোকানের দোতলায় লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। অথচ, তার বিপরীত পাশের সড়কে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ লাগানো চারটি সিসি ক্যামেরা আছে। যেগুলো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে এখানে ব্যক্তি উদ্যোগে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা লাগিয়ে চাঁদা তোলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। রসিদে চাঁদা আদায়কারীদের একটি ঠিকানা দেওয়া আছে। সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, দুই কক্ষের সাজানো-গোছানো কার্যালয়ে দুজন ব্যক্তি বসে আছেন। ভেতরের কক্ষে একটি মনিটরে সড়কে লাগানো সব ক্যামেরার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মো. রিপন নামের একজন নিজেকে এসব ক্যামেরার অপারেটর পরিচয় দেন।

মো. রিপন বলেন, ক্যামেরা লাগিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতা নুরুল আলম মিলন। কাউন্সিলর অনুমতি দিয়েছেন। প্রায় ২৫ লাখ টাকা খরচ করে ৬৪টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এসব ক্যামেরার জন্য মাসে দু-তিন লাখ টাকা খরচ আছে। সেটাই এলাকার লোকজনের কাছ থেকে তোলা হচ্ছে। তিনি জানান, নুরুল আলম মিলন দেশের বাইরে আছেন।

 এ বিষয়ে ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছির প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউকে এক পয়সা দেওয়া যাবে না। তারা ক্যামেরা লাগিয়েছে, সেগুলোর একটি রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আছে। সভায় বলা হয়েছিল, ৫০ টাকার বেশি খরচ নেওয়া যাবে না। এর বেশি টাকা নিয়ে চাঁদাবাজি করলে সব ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ চাঁদা আদায়কারীদের কার্যালয়ে গিয়ে কাউন্সিলরের দেওয়া অনুমতিপত্র পাওয়া গেছে জানালে মো. নাছির বলেন, ‘আমি সিসি ক্যামেরা লাগানোর অনুমতি দিছি। কিন্তু পয়সার বিনিময়ে না। পয়সা নিয়ে চাঁদাবাজি করতে পারবে না। যারা লাগিয়েছে তাদেরকে আমি চিনি। টাকা তোলার বিষয় জানতাম না, এখন কথা বলব।’

বনানী থানার ওসি সালাহ্‌উদ্দিন খান বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা লাগানোকে আমরা উৎসাহিত করি। সিসি ক্যামেরা থাকলে অপরাধী ধরতে অনেক সাহায্য হয়। সিসি ক্যামেরা রক্ষণাবেক্ষণে যে খরচ, তা সুবিধাভোগীদেরই দিতে হবে। তবে সেটার পরিমাণ আলোচনা করেই ঠিক করা উচিত।’