স্মৃতিজাগানিয়া গানের দোকান

চাহিদা নেই অডিও ক্যাসেট–সিডি–ভিসিডির। তাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসব দোকান। এর মধ্যেও দোকান ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। তারই একটি এলিফ্যান্ট রোডের গানের ডালি।  প্রথম আলো
চাহিদা নেই অডিও ক্যাসেট–সিডি–ভিসিডির। তাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসব দোকান। এর মধ্যেও দোকান ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। তারই একটি এলিফ্যান্ট রোডের গানের ডালি। প্রথম আলো

একটা সময় ছিল, যখন পয়লা বৈশাখ, ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসব সামনে রেখে সরগরম হয়ে উঠত অডিও সিডির দোকানগুলো। ভিড় লেগে থাকত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ-তরুণী থেকে মধ্যবয়সী সংগীতানুরাগী শ্রোতাদের। মাঝেমধ্যে আড্ডা বসত গানের গীতিকার, সুরকার, শিল্পীদেরও।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দোকান হারিয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোও অনেকটাই অচল। বছরের পর বছর ধরে ধুলো জমে গেছে ক্যাসেট, সিডি রাখার তাকে। দোকানগুলোও প্রাত্যহিক নিয়ম মেনে খোলা হয়। শুধু সেই ভিড় ও আড্ডা আর জমে না। গানের ব্যবসার ধরনটাই যে বদলে গেছে।

১৯৮৬ সাল। ভারতবর্ষে বাংলা ও হিন্দিভাষীদের কাছে শিল্পী মান্না দে তখন তুমুল জনপ্রিয়। এক দুপুরে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ইয়াকুব সুপার মার্কেটের ‘গানের ডালি’ দোকানে অতিথি হয়ে এলেন মান্না দে। বাইরে তখন কয়েক হাজার শ্রোতার উপচে পড়া ভিড়। গতকাল বুধবার বিকেলে সে স্মৃতিচারণা করছিলেন গানের ডালির স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মানিক। বলছিলেন, পুলিশ দিয়েও সে ভিড় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। সবাই চাইছিলেন মান্না দের অ্যালবাম কিনে তাঁর অটোগ্রাফ নিতে। এরপর আরও কয়েকজন জনপ্রিয় শিল্পী এসেছেন। শ্রোতাদের ভিড় হয়েছে ব্যাপক। কিন্তু যুগ বদলে যাওয়ায় সেসব এখন শুধুই স্মৃতি।

দেশের জনপ্রিয় সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গানের ডালির যাত্রা শুরু ১৯৭৮ সালে। তারও এক দশক আগে ঢাকায় গানের জগতে তখন অন্যতম প্রতিষ্ঠান ছিল ‘বাবুল রেডিও’। ১৯৬৮ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগ কার্যালয়ের অফিসের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) বাবুল রেডিও নামের দোকান চালু করেন পূর্ণ চন্দ্র দে। তখন শুধু মাইক ভাড়া ও রেডিও বিক্রি হতো। অনেক পরে বাবুল রেডিওর জায়গা হয় আজিজ সুপার মার্কেটের নিচতলায়। তাদের সংগ্রহে লংপ্লে রেকর্ড, অডিও ক্যাসেট আর সিডিতে উঠে আসে ১৯০২ সাল থেকে উপমহাদেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের গান। এর মধ্যে ছিলেন বেগম আকতার, লাল চাঁদ বড়াল, রাই চাঁদ বড়ালসহ অনেকে। তাকে তাকে ধুলো জমা লংপ্লে রেকর্ড আর সিডিগুলো থাকলেও এখন দোকানের লেনদেন টিকে আছে মূলত ফটোকপি আর কম্পিউটার গ্রাফিকসের কাজ দিয়ে। ২০১২ সালের পর স্বত্বাধিকারী পূর্ণ চন্দ্র দে-ও ফিরে গেছেন গ্রামের বাড়ি। সময়ের প্রবাহে বন্ধ হয়ে গেছে গীতালি, সুর সঙ্গমের মতো জনপ্রিয় রেকর্ডিং ও অডিও সিডির দোকানগুলো।

আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের নিচতলাতেই দেখা মেলে ‘সুরের মেলা’র। সামনের টেবিলজুড়ে লাগানো বিভিন্ন অডিও সিডির মলিন অ্যালবামের প্রচ্ছদ। সিডির বাজারে মন্দা লেগেছে বছর দশেক আগেই। টিকে আছেন কীভাবে, এমন প্রশ্ন করতেই স্বত্বাধিকারী মাসুদ মাহমুদ বলেন, ‘এখনো কিছু শ্রোতা আসেন। বেশির ভাগই মধ্যবয়সী। পুরোনো গানের সিডি খোঁজেন, যে গানগুলো ইন্টারনেটে অতটা পাওয়া যায় না। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী, ভীমসেন যোশি, যন্ত্রসংগীতের পণ্ডিত হরি প্রসাদ চৌরাসিয়া, ওস্তাদ জাকির হোসেনদের অ্যালবাম আছে। তবে চাহিদা এখন কমে গেছে। যেহেতু নিজের শখ থেকে দোকান করেছিলাম। যত দিন বেঁচে আছি, দোকানটাও থাকবে।’

একসময় দোকানটিতে নিয়মিত আড্ডা জমত আব্দুল জব্বার, বারী সিদ্দিকী, কৃষ্ণকলি ইসলাম, পথিক নবীর মতো শিল্পীদের। নতুন অ্যালবাম প্রকাশের আগে-পরে কিংবা কোনো উৎসবকে সামনে রেখে তাঁরা দোকানে আসতেন। চায়ের কাপ হাতে গল্প হতো, পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রোতারা আসতেন। সিডি কিনতেন, অটোগ্রাফ নিতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে চিত্রপটও পাল্টে গেছে। সিডির জন্য শিল্পী, শ্রোতাদের ভিড় এখন কেবলই ফেলে আসা দিনের স্মৃতি, বলছিলেন মাসুদ।

শাহবাগ থেকে এলিফ্যান্ট রোডমুখী সড়ক দিয়ে যেতে থমকে দাঁড়াতে হয় সুরের ভুবন নামের দোকানের সামনে। রাস্তার পাশেই সাউন্ড বক্সে বাজছিল হারানো দিনের হিন্দি ও বাংলা গান। দোকানের কাছে গিয়ে দেখা মিলল কর্মচারীসহ দোকানে বসে আছেন পরিচালক শাহ তারিক। আলাপচারিতায় বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই কিছু উৎসুক পথচারী এসে জিজ্ঞেস করেন, এই যুগেও সিডির দোকান কীভাবে চালান। তখন আমাদের কিছু বলার থাকে না। নতুন কোনো অ্যালবামও প্রকাশ হয় না। রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রগুলোও বস্তাবন্দী।’

কয়েক গজ দূরেই সুর বিতানের দোকান। টেবিলের ওপর রাখা কয়েকটি পুরোনো খাতা। তাতে লেখা বিভিন্ন অ্যালবামের নাম ও গানের শিরোনাম। পরিচালক শাহ আলম জানান, আগে মানুষ এসব খাতায় গানের নাম লিখে যেতেন অডিও ক্যাসেট বা সিডিতে গান রেকর্ড করার জন্য। অনেকে এখান থেকে গানের চরণ দেখেও গান পছন্দ করতেন। হতাশার সুরে শাহ আলম আরও বলেন, ‘এভাবে আর চলা সম্ভব নয়। কয়েক মাসের মধ্যে দোকানটাই বন্ধ করে ফেলব।’

স্মৃতি বয়ে বেড়ানো সারেগামা কারভান

রাজধানীর অডিও সিডির দোকানে এখন দেখা মিলছে সারেগামা কারভান নামের বিশেষ অডিও রেডিওর। পাঁচ হাজারের বেশি হারানো দিনের বাংলা, হিন্দি গান সংরক্ষণ করা আছে এতে। দাম ১৫ হাজার টাকা। বোতাম চাপলেই বেজে ওঠে কালজয়ী সুরগুলো, যে সুর টেনে নিয়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোতে।