২৬ অনিয়মে সাড়ে ২৬ কোটি টাকার ক্ষতি

কম পণ্য নিয়ে পুরো টাকা পরিশোধ, জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে অনিয়ম উঠে এসেছে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায়।

  • ২৭টি আপত্তি যাচাই-বাছাই করে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল কমিটি একটি আপত্তি বাতিল করে।

  • বাকি ২৬টির মধ্যে ১৯টিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট

জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও এমআরআই ফিল্ম সরবরাহের জন্য চুক্তি করেছিল একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কথা ছিল, প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বক্সে ১২৫টি করে ফিল্ম সরবরাহ করবে। তবে তারা করেছে ১০০টি করে।

এভাবে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট পণ্য কম নিয়েও পূর্ণ বিল পরিশোধ করে ১৮ লাখ ৭ হাজার ৫৬২ টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে। এ দুই অর্থবছরে ইনস্টিটিউটে এমন ২৬ ধরনের অনিয়ম পেয়েছে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর। তাদের নিরীক্ষায় এসেছে, এসব অনিয়মের মাধ্যমে ২৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগসহ আরও বিশেষ কিছু খাতে অনিয়ম হয়েছে। শুধু চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় ১২ কোটি ২৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার অনিয়ম হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, এসব অনিয়মের সঙ্গে ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. আবু হানিফ ও প্রধান সহকারী মো. শরীফুল ইসলামের সম্পৃক্ততা রয়েছে। পরিচালকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শরীফুল ইসলাম ছিলেন হাসপাতালটির ক্যাশিয়ার। তাঁকে নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে এবং সংশ্লিষ্ট পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) অনুমোদন ছাড়াই প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

অবশ্য শরীফুল ইসলাম দাবি করেন, প্রশাসনিক নিয়ম অনুযায়ীই তাঁর পদোন্নতি হয়েছে। আর হাসপাতালে অনিয়মের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি পরিচালক স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক আবু হানিফ বার্ষিক নিরীক্ষায় উঠে আসা আপত্তির বিষয়টি স্বীকার করেন। ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো এখনো প্রিম্যাচিউরড (অপরিণত)। নিয়মানুযায়ী, আপত্তিগুলো এজি অফিস (মহা হিসাবনিরীক্ষক) চূড়ান্ত করবে। এরপর সত্য-মিথ্যা প্রমাণিত হবে।’ তিনি বলেন, যখন আপত্তিগুলো চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হবে, কেবল তখনই এটা পাবলিকলি (প্রকাশ্যে) আসতে পারে।

অডিটের আপত্তিগুলোর বিষয়ে আমরা জবাব চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি। এখন নিয়ম অনুযায়ী এজি অফিস আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করবে।
মীর মুহ. নাছির উদ্দিন, স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও নিরীক্ষা দলের প্রধান

অবশ্য স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষকেরা বলছেন, আপত্তির বিষয়ে ইনস্টিটিউটের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা ব্যাখ্যা দেয়নি।

নথিপত্রে দেখা যায়, গত দুই বছরে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন বিভাগের জন্য বেশ কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রোপচার ও রোগ পরীক্ষার সামগ্রী কেনা হয়। এর মধ্যে ক্লিনিক্যাল কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার, এন্ডোস্কপিক ক্যামেরা, ফাইবার অপটিক লাইট কেব্‌ল, ফুল এইচডি মেডিকেল মনিটর, হেমাটোলজি অ্যানালাইজার, পোস্ট-ইউরোগ্রাফি সিস্টেম অন্যতম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভিক্টর ট্রেডিং করপোরেশন, তাবাসসুম ইন্টারন্যাশনাল ও পিউর ল্যাব টেক এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। এসব যন্ত্রপাতি কেনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছিল না। তার ওপর ভিক্টর ট্রেডিং ও তাবাসসুম ইন্টারন্যাশনাল যেসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে, সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানির সপক্ষে নথিপত্র (বিল অব এন্ট্রি ও শিপমেন্ট ডকুমেন্ট) পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনীয় নথিপত্র ছাড়াই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিল পরিশোধ করে।

স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় দেখা যায়, দরপত্র আহ্বান না করেই ভিক্টর ট্রেডিং করপোরেশনকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রোগীদের খাদ্য সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে মালামালের পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাবদ (নিশ্চয়তা) মোট মূল্যের ১০ শতাংশ জামানত নেওয়া হয়নি। এমনকি সরবরাহ করা মালামাল তিন সদস্যের সার্ভে (তদারকি) কমিটি বুঝে নেয়নি। এভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরাসরি ঠিকাদার থেকে মালামাল গ্রহণ করে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করে। একইভাবে দরপত্র, সার্ভে কমিটির অনুমোদন এবং নিশ্চয়তা জামানত ছাড়াই ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৪২ লাখ টাকার কিছু বেশি পরিমাণ অর্থ বিল হিসেবে তুলে নেওয়া হয়।

এ ভিক্টর ট্রেডিং থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে রোগ পরীক্ষার (প্যাথলজি) যন্ত্রপাতি কেনা হয়। নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, বাজারমূল্যের চেয়ে ৬৯ লাখ টাকা বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে।

নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে এসি, নন-এসি এবং পেয়িং বেডে যতসংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছিল, তার বিপরীতে যে পরিমাণ টাকা বিল হিসেবে পাওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে পাঁচ লাখ টাকা কম জমা হয়েছে।

নিরীক্ষায় আরও দেখা যায়, কিছু অস্ত্রোপচার ও রোগ পরীক্ষার কিছু ভারী যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে দরপত্রে শর্ত ছিল চারজনকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এর জন্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু কাউকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য না পাঠিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পুরো বিল পরিশোধ করা হয়।

আর্থিক অনিয়মগুলোর বিষয়ে কথা বলার জন্য ভিক্টর ট্রেডিং করপোরেশনের কর্ণধার কাওসার ভূঁইয়ার ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোনে কয়েক দফা ফোন করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। পরে প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরও অনিয়ম

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দরপত্র অথবা কোটেশন না করে ৬০টি বিলের মাধ্যমে ছোট যন্ত্রপাতি, ওষুধ, কেমিক্যাল রি-এজেন্ট ও লিনেনসামগ্রী ক্রয় দেখিয়ে ১২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। যদিও সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী, এভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে আর্থিক ব্যয়ের সুযোগ নেই।

জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগেও অনিয়ম হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত দুই অর্থবছরে এ পদ্ধতিতে সেখানে ১১১ জনের নিয়োগ হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে নিয়োগ দেখানো হয় ৬০ জনের। স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, এ তিন মাসে ৬০ জনের মধ্যে ২১ জনকে বেতন দেওয়া হয়। বাকি ৩৯ জনের বেতন বাবদ ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

নিয়মানুযায়ী, আউটসোর্সিং কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ হবে তাঁদের ব্যাংক হিসাবে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করেছে গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। ১১১ কর্মীর প্রত্যেককে সরকার নির্ধারিত বেতন ১৮ হাজার ৯৬৪ টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনেক কর্মীকে বেতন ২ হাজার টাকা করে কম পরিশোধ করে।

জানা গেছে, আউটসোর্সিং জনবল সরবরাহকারীর জনপ্রতি সরকার নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ হচ্ছে ৫ শতাংশ। কিন্তু বিল পরিশোধ দেখানো হয় ১৫ শতাংশ। তবে নিরীক্ষায় এ-সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র দেখাতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে সরকারের ১ লাখ সাড়ে ৫১ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে এসি, নন-এসি এবং পেয়িং বেডে যতসংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছিল, তার বিপরীতে যে পরিমাণ টাকা বিল হিসেবে পাওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে পাঁচ লাখ টাকা কম জমা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২৭টি আপত্তি যাচাই-বাছাই করে অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল (কিউসি) কমিটি একটি আপত্তি বাতিল করে। বাকি ২৬টির মধ্যে ১৯টিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে গত ১৬ জানুয়ারি ইনস্টিটিউটের পরিচালককে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর। এরপর ৩১ জানুয়ারি আরেক চিঠিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সময় পেরিয়ে গেলেও জবাব দেওয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও নিরীক্ষা দলের প্রধান মীর মুহ. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘অডিটের আপত্তিগুলোর বিষয়ে আমরা জবাব চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি। এখন নিয়ম অনুযায়ী এজি অফিস আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করবে।’