৩৬৭০ কোটি টাকার প্রকল্প, সক্ষমতার অর্ধেক অব্যবহৃত

  • দিনে ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের সমক্ষতা, করছে ২৪ কোটি লিটার

  • মিটফোর্ড এলাকায় পানির পাইপ সরু, ফলে পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না শোধনাগারটি।

ঢাকা ওয়াসা

পদ্মা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীবাসীকে সরবরাহ করতে ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু শোধনাগার থেকে পানি রাজধানীতে আনার সরবরাহ লাইনই স্থাপন করেনি সংস্থাটি। এ কারণে শোধনাগারের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে দুই বছর ধরে। এখন পানি সরবরাহের লাইন নির্মাণে আরও ৬৩২ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নিতে চাচ্ছে ওয়াসা।

মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পটি (পর্ব-১) ২০১৯ সালের অক্টোবরে চালু করা হয়। দিনে ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের কথা থাকলেও বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে গড়ে ২৪ কোটি লিটার।

শোধনাগার করা হলেও পানি সরবরাহ লাইন করা হয়নি। এখন আবার ৬৩২ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নিয়েছে সংস্থাটি।

শোধনাগার প্রকল্পটির (পর্ব-১) কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। পরে দুই দফায় বেড়ে ব্যয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন সরকার।

মূলত ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ–উপরিস্থ উৎস থেকে পানি সরবরাহ বাড়াতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শোধনাগারের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে না পারায় সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়নি। রাজধানীতে দিনে ২৬০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে, যার ৬৭ ভাগই ভূগর্ভস্থ।

শোধনাগার চালুর দুই বছর পরও সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে না পারার বিষয়টি বড় ক্ষতি বলে মনে করেন ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, এ নিয়ে একাধিকবার ওয়াসার বোর্ড সভায় সদস্যরা প্রশ্ন তুলেছেন। পরবর্তী সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।

ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব, নাকি চেষ্টা করেও পারছে না, তা পরিষ্কার নয়। তবে তাদের ঢিমেতাল ভাব পছন্দ না।
গোলাম মোস্তফা, চেয়ারম্যান , ঢাকা ওয়াসা বোর্ড

বড় ব্যয়, সুফল অর্ধেক

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগে পদ্মা-যশলদিয়া প্রকল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই শোধনাগার থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি ঢাকা ওয়াসার বিদ্যমান লাইনে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু প্রকল্পটি থেকে দৈনিক ১২ কোটি লিটার পানি ঢাকা শহরে সরবরাহ করা হচ্ছে।

আইএমইডির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। গত ৪ মার্চ ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, এই শোধনাগারের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পানি ঢাকা ওয়াসার লাইনে সরবরাহ করা হচ্ছে।

তবে ঢাকা ওয়াসার গত জুনের পানি উৎপাদন প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা–যশলদিয়া শোধনাগার থেকে দৈনিক গড়ে প্রায় ২৪ কোটি লিটার পানি পাওয়া গেছে, যা উৎপাদন সক্ষমতার ৫৩ শতাংশ।

ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ে বরাবর ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রকল্পটির পানি ঢাকায় আনা হচ্ছে। এই পাইপের ব্যাস ২ হাজার মিলিমিটার। ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, পদ্মার পরিশোধিত পানি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে মিটফোর্ড এলাকা দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করছে। পানির পাইপ এখানে এসে সরু হয়ে গেছে। ফলে সরবরাহের নেটওয়ার্ক প্রস্তুত না থাকায় পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হচ্ছে না।

ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের হয়ে প্রথম আলোর লিখিত প্রশ্নের জবাবে উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক বলেন, পদ্মা–যশলদিয়া শোধনাগারের পানি সরবরাহ লাইন শক্তিশালী করতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অর্থায়নের বিষয়ে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

এই প্রকল্পে অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয়ে পাইপলাইন নির্মাণে। এই নির্মাণের মান নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে। তা ছাড়া প্রকল্পের পরামর্শক দলের প্রধান ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান গ্রন্টমিজের বোদো গোপার্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে বলেন, প্ল্যান্টের ফাউন্ডেশনে যে কলাম ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো আন্তর্জাতিক মানের নয়, তাই বাদ দেওয়া প্রয়োজন।

অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, জনগণকে পানি সরবরাহ প্রকল্পের ‘কাগজীয় উদ্দেশ্য’। নিজেদের লাভ ‘মূল উদ্দেশ্য’। যার যার ‘কমিশন’ সবাই পেয়ে গেছে। জনগণ পানি পেল কি পেল না, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।

৬৩২ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প

শোধনাগারের নির্মাণকাজ শেষের পরে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সরবরাহ লাইন করতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগারের পরিশোধিত পানি ঢাকা শহরে সরবরাহ করার লক্ষ্যে মেইন লাইন নির্মাণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ব্যয়ের প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত।

ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব আছে, নাকি চেষ্টা করেও প্রকল্পের অনুমোদন করাতে পারছে না, তা পরিষ্কার নয়। তবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের ঢিমেতাল ভাব পছন্দ নয়। বিদেশি অর্থায়ন বা সরকারের বরাদ্দ না পাওয়া গেলে নিজেদের টাকায় কাজ শুরু করা হবে।