জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করে তাতে নারী প্রার্থীদের সরাসরি নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন নারী অধিকারকর্মীরা। পাশাপাশি সাধারণ আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী দেয়, সে দাবিও করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নারী অধিকারকর্মীরা এ দাবি জানান। তাঁরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নারী অধিকারকর্মীদের একটি বৈঠক আয়োজনেরও অনুরোধ জানান।
জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’ নামে ৩১ আগস্ট আত্মপ্রকাশ করা নতুন সংগঠনের ব্যানারে এই আলোচনায় অংশ নেন নারী অধিকারকর্মীরা। আলোচনার জন্য এই সংগঠনের পক্ষ থেকে ঐকমত্য কমিশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠকে নারী অধিকারকর্মীদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত জাতীয় জুলাই সনদে জাতীয় সংসদে নারীর আসন বিষয়ে আইন সভাবিষয়ক অধ্যায়ের ২৪ অনুচ্ছেদ বিষয়ে সংশোধনী ও সংযুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২৫-পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গঠিতব্য জাতীয় সংসদ উপযুক্ত বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনার সুযোগ পাবে। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, নারী সংগঠন ও বিশেষজ্ঞ মহলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পদ্ধতিগত আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন ও জাতীয় সংসদে নারীর বর্ধিত ও কার্যকর প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, নারী অধিকারকর্মীরা দাবি পূরণের জন্য যাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্মত করার চেষ্টা করেন। কারণ, কমিশন সুপারিশ করতে পারলেও বাস্তবায়নের এখতিয়ার নেই। বাস্তবায়ন করার কাজটি করবে রাজনৈতিক দল।
নারী অধিকারকর্মীদের পক্ষে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, নারীপক্ষের সভাপতি গীতা দাস, প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সীমা দত্ত, ক্ষুব্ধ নারী সমাজের ঋতু সাত্তার, শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য তাসলিমা আখতার, নারীর ডাকে রাজনীতির ওয়াসিমা ফারজানা, নারীপক্ষের সদস্য সাদাফ সায্ সিদ্দিকী, দুর্বার নেটওয়ার্কের মাহমুদা খাতুন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নাজিফা জান্নাত, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার শাহনাজ পারভীন ও ফেমিনিস্ট অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশের (ফ্যাব) তৃষিয়া নাশতারান। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা ডাকসু নির্বাচনের কারণে বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারেননি বলে জানানো হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজসহ কমিশনের সদস্যরা।
বৈঠকের বিষয়ে রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়ার পর কমিশন এ বৈঠক ডাকে। আমরা নারী আসন নিয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও হতাশার কথা জানিয়েছি।’
রাশেদা কে চৌধূরী আরও বলেন, ‘১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থা সাংবিধানিক আদেশে করা যেতে পারে। সেটা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেই সম্ভব। বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা বিবেচনা করেই এই দাবি করা হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে মূল তিনটি দাবিই পূরণ করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আমরা ভরসা রাখতে চাই।’
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে রাশেদা কে চৌধূরী জানান।
এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই পর্বে আলোচনা শেষ হয় ৩১ জুলাই। এতে সিদ্ধান্ত হয়, আগের মতো জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৫০ থাকবে। সেসব আসনে আগের মতো দলীয়ভাবে মনোনয়নের ব্যবস্থা থাকবে। আর ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলগুলো ৫ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেবে নারীদের। এই পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়নে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থীর মনোনয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রতিটি নির্বাচনে ৫ শতাংশ বর্ধিত হারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন অব্যাহত রাখবে। ২৯টি দল ও জোট এতে একমত হয়। নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দেয় আমজনতার দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল। প্রস্তাবিত জুলাই সনদের ২৪ অনুচ্ছেদে এসব প্রস্তাব যুক্ত করা হয়েছে।
নারীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং জাতীয় সংসদে নারী আসন ও সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ না হওয়া ও ঐকমত্য কমিশনে কোনো নারী সদস্য না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নারী অধিকারকর্মীরা।
মঙ্গলবার বৈঠক শেষে নারীপক্ষের গীতা দাস প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চান। এ জন্য ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা বৈঠক আয়োজনের অনুরোধ করেছেন তাঁরা।