সাধারণ ঘূর্ণিঝড়েও চার কারণে বেশি গাছ উপড়ে পড়ল

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়াররিং ইনস্টিটিউটের অপর পাশে সড়ক বিভাজকের ওপরে থাকা দুটি বড় গাছ উপড়ে পড়েছে। ঢাকা, ২৫ অক্টোবর
ছবি: আশরাফুল আলম

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির খবর এখনো আসছে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে ১৪ জনেরই মৃত্যু হয়েছে গাছচাপায়। এবার ঘূর্ণিঝড়ে সড়ক ও বাড়িতে লক্ষণীয়–সংখ্যক গাছ উপড়ে পড়েছে। অথচ এ ধরনের সাধারণ ঝড়ে অতীতে কখনো এত গাছ উপড়ে পড়েনি।

প্রকৃতি ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশ উপকূলে আঘাতের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ৬০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার।

বাতাসের এমন গতিবেগে এত বেশি গাছ উপড়ে পড়ার কথা নয়। এ জন্য তাঁরা চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।

গত সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড়ে গাছ পড়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম, ঢাকা–খুলনা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীসহ দেশের অন্তত ২০ জেলায় বাড়ি ও উম্মুক্ত স্থানে বিশেষ করে পার্ক ও সামাজিক বনায়ন হয়েছে এমন এলাকায় অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়েছে। এর আগে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও ইয়াসে ডালপালা ভাঙলেও গাছ উপড়ে পড়েছে কম।

ঝড়ের রাতে সড়ক ও অন্যান্য স্থানে উপড়ে পড়া গাছের ছবি পর্যবেক্ষণ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে প্রথম আলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমত, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে উপড়ে পড়া বেশির ভাগ গাছের শিকড় ছিল ছোট। দ্রুত বর্ধনশীল গাছগুলোর ধরন হালকা। এমন প্রজাতির গাছ ও ছোট শিকড়ের গাছ বেশি উপড়ে পড়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সড়কের ওপর পড়ে আছে গাছ। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড থেকে ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার সকালে তোলা
ছবি: এস এস আল আরেফিন

দ্বিতীয়ত, ঝড় শুরুর আগেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি নরম হয়ে গেছে। এতে দুর্বল ও ছোট শিকড়ের গাছগুলো উপড়ে পড়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঝড়ের সময় বাতাসের গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭৫ কিলোমিটার উঠেছিল। কালবৈশাখীর চেয়ে কিছুটা বেশি গতির ওই ঝড়ে বাতাসের ধরন ছিল একটু ভিন্ন। ঝড়ে সাধারণত বাতাস সমুদ্র থেকে সমান্তরালভাবে সরাসরি উপকূলে আঘাত করে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। ফলে গাছের ডালপালা বেশি ভাঙে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে, সেগুলোর সঙ্গে সিত্রাংয়ের একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল, ঝড়ের আগে বৃষ্টির কারণে গাছের শিকড় ও মূল দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এই ঝড়ের একাধিক ঘূর্ণিবায়ু ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়। ওই ঘূর্ণন ও মাটি নরম থাকায় বেশি গাছ দ্রুত উপড়ে পড়ে।

রাস্তায় গাছ পড়ে থাকায় যান চলাচলে বাধা
ছবি: সাইফুল ইসলাম

তৃতীয়ত, সড়কের পাশে ও সড়ক বিভাজকে উঁচু ও নরম কাঠ, এমন প্রজাতির গাছ লাগানো নিরুৎসাহিত করা হয়। দেশের অন্তত ১০টি জেলায় উপড়ে পড়া গাছের ছবি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভেঙে পড়া বেশির ভাগ গাছ ছিল কৃষ্ণচূড়া, লম্বু, শিশু, রেইনট্রি ও ইউক্যালিপটাস। এসব গাছ অপেক্ষাকৃত লম্বা, দুর্বল এবং শিকড় মাটির নিচে খুব বেশি যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার সড়কে বিদেশি প্রজাতির কাঠের লম্বা ও দুর্বল গাছ সড়কে বেশি রোপণ করা হয়। একটি দুর্বল ঘূর্ণিঝড়ে কী হতে পারে, গত সোমবার রাতে তা দেখা গেছে। তাই সড়কে ধীরে বড় হয় এবং শক্ত প্রজাতির গাছ যেমন তেলসুর, শাল ও গর্জন গাছ রোপণ করা উচিত।

চতুর্থত, দেশের বেশির ভাগ গাছের চারা নার্সারি থেকে কিনে রোপণ করা হয়। বেশির ভাগ নার্সারির মালিক পলিথিনের মধ্যে গাছের চারা তৈরি করতে গিয়ে শিকড় কেটে ছোট রাখেন। এ কারণে গাছ রোপণের পরও শিকড় বড় হয় না। ফলে অতি ভারী বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাসে এসব গাছ উপড়ে পড়ে।

প্রকৃতিবিষয়ক সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন নার্সারি থেকে বেশি চারা সংগ্রহ করা হয়। কেটে ছোট রাখায় এসব চারার শিকড় মাটির বেশি গভীর যেতে পারে না। এ কারণে বৃষ্টি ও ঝড়ে অনেক গাছ উপড়ে পড়ে।

সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টির সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে। জেনারেল হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২৫ অক্টোবর
ছবি: শাহাদৎ হোসেন

বাংলাদেশ নার্সারি মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট পাঁচ হাজার নার্সারি আছে, এর মধ্যে তিন হাজার ঢাকায়। নার্সারিতে ৯০ শতাংশ হচ্ছে শিশু, ইপিলইপিল, ইউক্যালিপটাস ও কৃষ্ণচূড়া প্রজাতির। এসব চারার দাম কম। দেশি প্রজাতির ও কাঠের শক্ত গাছ যেমন তেলসুর, চাপালিশ, গর্জন ও শালগাছের চারার দাম বেশি। আর বিদেশি প্রজাতির গাছ ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পরিণত হয়ে যায়।

প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিতে দেশি গাছকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছি। দেশি জাতের, মাঝারি আকৃতির ও শক্ত প্রজাতির গাছের চারা আমরা নিজেরা উৎপাদন করে বিতরণ করছি।’