ইউএনএফপিএর প্রতিবেদন
নিজের সিদ্ধান্তমতো সন্তান নিতে পারেন মাত্র ২৩% নারী
দেশে মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর।
ছোট পরিবার গঠনের দিকে ঝোঁক বেশি।
তরুণ জনগোষ্ঠী বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়ে।
দেশে নিজের আকাঙ্ক্ষামতো পরিকল্পনা করে সন্তান নিতে পারেন মাত্র ২৩ শতাংশ নারী। অর্থাৎ কখন সন্তান নেবেন, কয়টি সন্তান নেবেন, একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে কত বছর বিরতি দেবেন—সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না দেশের ৭৭ শতাংশ নারী। বৈশ্বিক হিসাবে ৩৭ শতাংশ নারী এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
নারীর নিজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সন্তান নেওয়ার পথে প্রধান বাধা হচ্ছে, স্বামীর যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়া এবং পারিপার্শ্বিক চাপ। যেমন ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি, সংসারের খরচ, চাকরি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি।
সোমবার জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২৫’ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। রাজধানীর গুলশানে ইউএনএফপিএ কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবারের প্রতিবেদনে যে ১৪ দেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নেই।
তবে এতে বাংলাদেশ জনমিতিক ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদন ২০২২ থেকে উপাত্ত দিয়ে জনসংখ্যা ও প্রজননস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক চিত্র, প্রজননহার, গড় আয়ু, প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার, জেন্ডার সমতা, বাল্যবিবাহ, পরিবার পরিকল্পনাপদ্ধতি গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে। অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, গড় আয়ু ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হারের দিক দিয়ে বিশ্ব পরিস্থিতির চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো।
অনুষ্ঠানে ‘দ্য রিয়েল ফার্টিলিটি ক্রাইসিস’ (প্রজনন–সংক্রান্ত প্রকৃত সংকট) শিরোনামের বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের প্রতিনিধি ক্যাথেরিন ব্রিন ক্যামকং। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিষয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করেন ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডেটা অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান মোহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম এবং সংস্থার যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার (এসআরএইচআর) বিশেষজ্ঞ আবু সায়েদ মোহাম্মদ হাসান।
দেখা গেছে, সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—এমন নারীদের ক্ষেত্রে নিজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সন্তান নিতে পারার হার বেশি, ৩৬ শতাংশ। অপর দিকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না—এমন নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ১২ শতাংশ।
ক্যাথেরিন ব্রিন ক্যামকং বলেন, ‘আমাদের এখন পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে সরে আসতে হবে। মানুষ আর সন্তান চায় না বা যে নারী সন্তান নেওয়ার সময় পিছিয়ে দেন, তিনি স্বার্থপর—এমন ভাবলে চলবে না। বাস্তবে অনেক মানুষই সন্তান নিতে চান, কিন্তু তাঁদের পথে রয়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধা। এসব বাধা দূর করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের প্রজনন বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে।’
অনুষ্ঠানে বলা হয়, এ বছরের প্রতিবেদন জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও জনসংখ্যায় ধস—এ দুটো প্রসঙ্গের ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়টি দেখেছে। ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে প্রজননহার কমছে। আবার এ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ হওয়ার আভাস আছে। বিশ্বের জনসংখ্যা হচ্ছে ৮২০ কোটি। এক–চতুর্থাংশ মানুষ যেসব দেশে থাকে, সেগুলোতে এখনই জনসংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখ। বাংলাদেশে গত দশক থেকে মোট প্রজননহার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর) কমেছে। তা সত্ত্বেও আগামী দশকজুড়ে জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। কারণ, তরুণদের বড় অংশ এ সময়ে প্রজননের বয়সে ঢুকবে।
কখনো কম, কখনো বেশি সন্তান নিতে হচ্ছে
ইউএনএফপিএর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২৬ শতাংশ নারী আকাঙ্ক্ষার চেয়ে কম সন্তান নিতে পেরেছেন। আর আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশি সন্তান নিতে হয়েছে ১৭ শতাংশ নারীকে। বিশ্বে এ হার যথাক্রমে ১১ ও ৭ শতাংশ।
নারী ও পুরুষ—দুজনের ক্ষেত্রেই সন্তান নেওয়া ও না নেওয়ার চাপ রয়েছে। তবে নারীর ক্ষেত্রে তা কিছুটা বেশি। ৩৩ শতাংশ নারী ও ২৩ শতাংশ পুরুষ যৌন সম্পর্ক স্থাপন না করতে চাইলেও ‘না’ বলতে পারেন না। ২৩ শতাংশ নারী ও ২২ শতাংশ পুরুষ পছন্দমতো জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। প্রতি ৩ জন নারীর ১ জন (৩২ শতাংশ) অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হন।
ইউএনএফপিএর শাহিদুল ইসলাম বলেন, একজন নারীর প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার হচ্ছে তাঁর আকাঙ্ক্ষা অনুসারে সন্তান নিতে পারার অধিকার। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমানো ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষায় নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা খুব জরুরি। দেখা গেছে, সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—এমন নারীদের ক্ষেত্রে নিজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সন্তান নিতে পারার হার বেশি, ৩৬ শতাংশ। অপর দিকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না—এমন নারীদের ক্ষেত্রে নিজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সন্তান নেওয়ার হার মাত্র ১২ শতাংশ।
প্রতিটি গর্ভধারণ যেন আকাঙ্ক্ষিত হয়, প্রতিটি জন্ম যেন নিরাপদ হয় এবং প্রত্যেক তরুণের সম্ভাবনাকে যেন কাজে লাগানো হয়, সে লক্ষ্য নিয়ে সরকারকে নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মনে করেন ইউএনএফপিএর আবু সায়েদ মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেন, সমন্বিত যৌনশিক্ষা, প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার, গর্ভপাতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধের বিষয়ে সংস্কার আনা, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশে গড় আয়ু বেশি
বাংলাদেশের নারী ও পুরুষের গড় আয়ু এখন বিশ্বের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর হলেও বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭৪ বছর। নারীদের ক্ষেত্রে বিশ্বে গড় আয়ু ৭৬ বছর এবং বাংলাদেশে ৭৭ বছর। শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর দিক দিয়েও বিশ্ব পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়ে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে সমান অবস্থানে।
দেশে মোট প্রজননহার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর) ২ দশমিক ১ শতাংশ উল্লেখ করে জানানো হয়, এই হার বহু বছর ধরে এক জায়গায় আটকে আছে। অর্থাৎ দেশের নারীরা গড়ে দুটির মতো সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। দেশের দম্পতিদের ছোট পরিবার গঠনের দিকে ঝোঁক বেশি। সুশাসন, বিনিয়োগ, পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারলে এর সুফল পাবে বাংলাদেশ।
সরকারিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহে ঘাটতি এবং মা-শিশুর স্বাস্থ্য ও প্রসবের জন্য সহায়তামূলক ওষুধ ও সরঞ্জামাদি–সংবলিত ডিডিএস কিটের মজুত না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় অনুষ্ঠানে। ইউএনএফপিএর কর্মকর্তা আবু সায়েদ মোহাম্মদ হাসান জানান, জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব বাজেট থেকে এই কেনাকাটা করার পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ইউএনএফপিএর পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।