আধুনিক ভবনের মসজিদটিতে ৩৭৩ বছরের পুরোনো শিলালিপি

চুড়িহাট্টার মোগল আমলের আদি মসজিদটি বিলুপ্ত। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মার্বেল টাইলসে মোড়ানো জাঁকজমকপূর্ণ এক বহুতল নতুন ইমারত, এটাই বর্তমানের চুড়িহাট্টা মসজিদছবি : খালেদ সরকার

চুড়িহাট্টার প্রসঙ্গ উঠলেই এখন মনে পড়ে রাজধানীর পুরান ঢাকায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে যে অগ্নিকাণ্ডে তাৎক্ষণিক ৬৭ জন এবং  চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৪ জনসহ মোট ৭১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন।

এই ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল ঐতিহাসিক স্থাপনা চুড়িহাট্টা মসজিদের ঠিক সামনে। এখানে তিনটি সরু গলি এসে মিলেছে। পূর্ব দিকে চকবাজার থেকে এসেছে আওলাদ হোসেন লেন, আর এসেছে নন্দকুমার দত্ত রোড ও হায়দার বক্স লেন। তিন লেনের মিলন ঘটায় একচিলতে চত্বরের মতো পরিসর তৈরি হয়েছে মসজিদের সামনে। আর অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল আওলাদ হোসেন লেনের শেষ মাথায় মসজিদের ঠিক সামনে ওয়াহেদ ম্যানসন নামের একটি ভবনের সুগন্ধির গুদামে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সেখানে দেখা গেল, আগুনে ঝলসানো ওয়াহিদ ম্যানসন সংস্কারের পর আবার নতুন সাজে শোভিত হয়েছে। আর চুড়িহাট্টার মোগল আমলের আদি মসজিদও বিলুপ্ত। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মার্বেল টাইলসে মোড়ানো জাঁকজমকপূর্ণ এক বহুতল নতুন ইমারত।

হারিয়ে গেল তিন গম্বুজ মসজিদ

চুড়িহাট্টার মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজবিশিষ্ট। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে বাংলার সুবাদার ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ সুজা। তার সুবাদারির কালেই মোহাম্মদ বেগ নামের এক মোগল কর্মকর্তা চুড়িহাট্টায় তিন গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।

মসজিদের ভেতরে থাকা কালো পাথরের লেখা অনুবাদ করেছেন মুনশী রহমান আলী তায়েশ। তা থেকে এই তথ্যগুলো জানা যায় (ফলকটি এখন নতুন ভবনের দোতলার মেহরাবের ওপরে বসানো হয়েছে)। তিনি উল্লেখ করেন, চুড়িহাট্টা মসজিদটি ছিল আকারে ছোট, কিন্তু খুব শক্তপোক্ত। এর দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট এবং প্রস্থ ১৩ ফুট। নির্মাণকাল হিজরি ১০৬০ মোতাবেক ১৬৪৯ বা ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ।

আ ক ম যাকারিয়া তাঁর বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বইতে উল্লেখ করেছে পুরোনো তিন গম্বুজ মসজিদটির প্রথমবার সংস্কার করা হয়েছিল ১৯০৬ সালে।

শিলালিপি থেকে জানা যায়, চুড়িহাট্টা মসজিদের নির্মাণকাল হিজরি ১০৬০ মোতাবেক ১৬৪৯ বা ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ
ছবি : খালেদ সরকার

ঢাকার ইতিহাসভিত্তিক বইগুলোতে আছে চুড়িহাট্টা মসজিদের বর্ণনা। এর ছাদের ওপর ছিল তিনটি গম্বুজ। চার কোনায় ছিল চারটি মিনার। পূর্ব দিকের দেয়ালে তিনটি দরজা। এর ওপরে ছিল চারকোনা আকৃতির খিলান। মসজিদের সামনের দেয়াল ছিল বদ্ধ খিলান নকশায় অলংকৃত।

এ ছাড়া চুড়িহাট্টা মসজিদটির স্থাপত্যরীতিতে ছিল বিশেষ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। মসজিদটির ছাদ ছিল ঢালাই করা। এর আকৃতি ছিল বাংলার চৌচালা ঘরের মতো। মির্জা নাথানের বাহারীস্তান-ই–গায়েবী বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, মোগল আমলে বাংলায় বেশ কিছু পাকা ভবন তৈরি করা হয়েছিল, যেগুলোর আকৃতি ছিল স্থানীয় কুঁড়েঘরের মতো। এর কোনো কোনোটির ছাদ ছিল চৌচালা, কোনোটির দোচালা ঘরের মতো। বেগমবাজারের করতলব খান মসজিদের উত্তর পাশের দেয়ালের সঙ্গে যুক্ত দোচালা ঘরের মতো একটি ঘর এখনো রয়েছে। কিন্তু চুড়িহাট্টার চৌচালা ছাদের মসজিদটি আর নেই।
বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ধারণা করা হয় চুড়িহাট্টা মসজিদটিই ছিল মোগল শাসনামলে বাংলায় কুঁড়েঘর আকৃতির ইমারতের মধ্যে প্রথম নিদর্শন। আক্ষেপের বিষয়, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নসম্পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে চিরতরে।

নতুন অধ্যায়

চুড়িহাট্টা মসজিদের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে ২০০৮ সাল থেকে। গত বৃহস্পতিবার পবিত্র জোহর নামাজের জামাতের পরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হলো মসজিদের ইমাম মুফতি রশিদ আহমদ, মোয়াজ্জিন আল ইমরান, নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সদস্য, স্থানীয় প্রবীণ মুসল্লি মো. খোরশেদুল ইসলামসহ অনেকের সঙ্গে।

চুড়িহাট্টা মসজিদের ভেতরের একাংশ
ছবি : খালেদ সরকার

কথা বলে জানা গেল, মসজিদটিতে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। পুরোনো মসজিদের ভেতরে তিন কাতার ও সামনের বারান্দায় তিন থেকে চার কাতারে মাত্র তিন শর মতো মুসল্লি জামাতে অংশ নিতে পারতেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। চারপাশে হাজারো দোকানপাট। মুসল্লির সংখ্যাও প্রচুর। এদিকে মসজিদটির জায়গা মাত্র পাঁচ কাঠার মতো। পুরোনো ভবনটি রেখে সম্প্রসারণ করার মতো জায়গাও পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে প্রয়োজনের তাগিদেই পুরোনো ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন করার কাজ শুরু হয়।

প্রথম দফায় তৃতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়। এ বছরই চতুর্থ তলার কাজ শেষ হয়েছে। নিচের তলার মেঝে, প্রধান মেহরাব, প্রতিটি সিঁড়ি মার্বেল পাথর দিয়ে মোড়ানো। অন্য তলার মেঝেতে বিছানো হয়েছে উন্নত টাইলস। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বসানো হয়েছে। ছাদে ঝুলছে বিশাল ঝাড়বাতি। অজুর জন্য উভয় পাশে আছে প্রশস্ত অজুখানা। সব মিলিয়ে এখন প্রায় আড়াই হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

এ ছাড়া তিনটি আলাদা কর্মসূচি চলছে মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগে। পবিত্র জোহরের নামাজের পর শিশুদের জন্য কোরআন শিক্ষা, এশার পর বড়দের জন্য কোরআন শিক্ষা এবং হেফজখানা। সবই বিনা মূল্যে। জানা গেল, এই মসজিদে জুমার নামাজের সময় বা ওয়াক্ত নামাজে কোনো দানবাক্স চালানো হয় না। মসজিদের প্রধান প্রবেশপথে একটি দানবাক্স করা হয়েছে। কেউ স্বেচ্ছায় দান করতে আগ্রহী হলে সেখানে দান করেন। মসজিদের দশজন স্টাফ, কোরআন ও হেফজ শিক্ষার শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতি মাসে দেড় লাখ টাকার বেশি খরচ।

এর সবই দিয়ে থাকেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা জানান, চুড়িহাট্টার ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। আল্লাহর ঘরে প্রতি মাসে পাঁচ–সাত হাজার টাকা দান করা তাঁদের কাছে কিছুই না। তাঁদের দানেই মসজিদটির নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। পরিচালিতও হচ্ছে। খতম তারাবিহ হচ্ছে, প্রতিদিন দুই শ থেকে আড়াই শ রোজাদারের ইফতারের ব্যবস্থা থাকে। পুরোনো ভবনে এসব আয়োজন সম্ভব হতো না।

প্রয়োজন বড় দায়। সাধারণত তাকে এড়ানো যায় না। সে কারণেই চুড়িহাট্টার চৌচালা তিন গম্বুজ মসজিদের জায়গায় এখন দাঁড়িয়ে আছে চারতলা নতুন ভবন। আর পুরোনো মসজিদটি শুধুই ইতিহাসের পাতায় থাকা এক ধূসর অতীত।