ফুটবল–কূটনীতিতে সাফল্যের পালক মুহসীন হল মাঠ

৪৫ বছরের বিরতি শেষে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বনানীতে পুনরায় চালু করা হয় আর্জেন্টিনার দূতাবাস। কূটনৈতিক এই অগ্রগতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনার প্রতি বাংলাদেশের ফুটবল–ভক্তদের সমর্থন

সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ। অনেক দিন ধরে বাক্যালাপই বন্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের। অবশেষে এই সময়ে এসে দুই দেশের আলোচনার দুয়ার খুলল টেবিল টেনিস। এই খেলার ভেতর দিয়ে পরস্পরের ব্যাপারে সহনীয় হয়ে উঠেছিল দুই দেশ। এখন পর্যন্ত বিশ্বে কূটনীতির ইতিহাসে বড় এক অধ্যায় হয়ে আছে সেই পিংপং ডিপ্লোমেসি।

বাংলাদেশও এবার খেলা নিয়ে এ রকম এক ইতিবাচক কূটনীতির সাক্ষী হলো। ফুটবল–কূটনীতি দুয়ার খুলল ঢাকায় আর্জেন্টিনা দূতাবাসের। না, আর্জেন্টিনার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ‘চীন-যুক্তরাষ্ট্র’জাতীয় খারাপ সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু পরস্পরের দেশে দূতাবাসও বন্ধ ছিল সাড়ে চার দশক ধরে। তাতে কমবেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে দুই দেশের নাগরিকদের। অবশেষে সেই দূতাবাস ঢাকাতে খুলল আর্জেন্টিনা। আর এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে ফুটবল, বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রতি সমর্থন এবং বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উন্মাদনা।

আর্জেন্টাইন ফুটবল ক্লাব রিভার প্লেটের ঢাকায় দুটি একাডেমি করতে চাওয়া বা বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকে আর্জেন্টিনায় খেলতে নিয়ে যাওয়া—এসবই কিন্তু এসেছে এই সূত্র ধরে।

বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় আর্জেন্টিনা সমর্থকদের পাগলপারা সমর্থনই আসলে দুই দেশের সম্পর্কটা নতুন করে তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু আর্জেন্টিনার ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের দর্শকদের এই ভালোবাসা তো নতুন কিছু নয়। মেসির আগে ম্যারাডোনা আমলেও মানুষ আর্জেন্টিনাকে ভালোবাসা দিয়েছেন প্রাণভরে। কিন্তু এবার এই ভালোবাসা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল মাঠ থেকে। বিশ্ববাসী দেখেছেন মাঠে জড়ো হওয়া হাজার হাজার সমর্থকের ভালোবাসার জোয়ার। মুহসীন হলের মাঠে খেলা দেখার আয়োজন করেছিল মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক ঘটনার এ পরিণতি দেখে বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনার প্রতি বাংলাদেশের এই ভালোবাসা অনেক দিনের। আমিও সেই ভালোবাসারই পথিক।’

তানভীর জানান, বিশ্বকাপের শুরুতেই ঢাকায় বড় পর্দায় বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখানোর পরিকল্পনা করেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন খেলা দেখানোর সিদ্ধান্ত নিই, তখন কল্পনা করিনি ব্যাপারটা এত বড় হয়ে যাবে। এত বড় একটি ঘটনার প্রভাবক ছিল নগদ, এটি আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের ব্যাপার।’

মুহসীন হল মাঠ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও স্বোপার্জিত স্বাধীনতায় বড় পর্দায় ফুটবল দেখানোর আয়োজন করে নগদ। এ আয়োজন এতটাই সাড়া ফেলে যে এসব জায়গায় খেলা দেখার খবর করতে আর্জেন্টিনা থেকেও সাংবাদিক চলে আসেন। দেশ-বিদেশের ছোট-বড় অনেক গণমাধ্যমে আর্জেন্টিনার ফুটবলের প্রতি এই ভালোবাসার খবর প্রচার হতে থাকে। বিশ্বের নামকরা সেলিব্রিটিরা এই মাঠের ছবি পোস্ট করেন টুইটার, ফেসবুকে।

তানভীর বলেন, ‘আমার ভাবতে খুবই ভালো লাগছে যে আমাদের একটা আয়োজন থেকেই দুটি দেশ এতটা কাছে আসতে পারল।’ তিনি বলেন, নগদ তারুণ্যের কথা বলতে চায়। সে কারণে তরুণদের খেলা দেখার জন্য এই আয়োজন করেছিলেন তাঁরা। এই মুহসীন হলের মাঠের উল্লাস প্রতিধ্বনিত হয়েছিল অসংখ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে, যেখান থেকে আর্জেন্টিনার অনেক মানুষ জানতে পেরেছেন বাংলাদেশের কথা, বাংলাদেশের মানুষের মেসি-ম্যারাডোনার প্রতি তীব্র ভালোবাসার কথা।

তানভীর এ মিশুক বলেন, ‘এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের দেশের আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের ভক্তদের কথা জানতে পেরেছে লিওনেল মেসির দল, জানতে পেরেছেন আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি। আর বিশেষভাবে বলতে হবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই চিঠি, যার কারণে আজ দুটি দেশের সম্পর্ক পেল নতুন কূটনৈতিক পরিচয়।’

বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের এই আয়োজন নিয়ে মেসি ও তাঁর দলকেও কথা বলতে হয়েছে। দলের কোচ লিওনেল স্কালোনিও এ নিয়ে কথা বলেন। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের উৎসবে উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে বাংলাদেশের সম্পর্ককে অন্য স্তরে নেওয়ার কথা বলেন। এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টকে বিশ্বকাপ জয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে দূতাবাস খোলার আহ্বান জানান। আর সেই থেকেই এখন ঢাকায় দেখা গেল আর্জেন্টিনার দূতাবাস।

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন না অনেকেই। এখান থেকে আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও অন্য মাত্রায় পৌঁছাবে বলে আশা করেন তাঁরা। তবে তানভীর এ মিশুক স্বপ্ন দেখেন, এই প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের ফুটবল।