অবৈধ পথে অভিবাসী হতে কেন মরিয়া রোহিঙ্গারা

বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হচ্ছেন বা হওয়ার চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা। মানব পাচারকারীরা অর্থের বিনিময়ে তাঁদের অবৈধ পথে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে বাঁচার তাগিদ, জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে তাঁরা এই পথ বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু এতে ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি।

সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টাকালে টেকনাফে উদ্ধার হওয়া ৫৮ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। গত ২৫ নভেম্বর টেকনাফ থানা থেকে তোলাছবি: প্রথম আলো

সিরিয়া থেকে পালিয়ে জার্মানিতে যাওয়া শরণার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত গায়ক স্টিং ‘ইনশা আল্লাহ’ গানটি গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। অসাধারণ আবেগ দিয়ে লেখা গানটির শব্দচয়ন শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, তাঁদের মনে সমবেদনা জাগিয়েছে। কিন্তু তাতে বিশ্বজুড়ে পালিয়ে, অবৈধভাবে বা ঝুঁকিপূর্ণ পথে অভিবাসনেচ্ছু মানুষের স্রোতে এতটুকু ভাটা পড়েনি। বিশ্বায়নের ধারক ও বাহক হিসেবে অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। তবে ক্রমবর্ধমান অনিয়ম এবং অপরাধী ও পাচারকারী চক্রের অপতৎপরতায় বিশ্বব্যাপী অভিবাসন এক নতুন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অবৈধ পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, আর্থিক ক্ষতি এমনকি মানব পাচারের কবলে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া গন্তব্য দেশে ভাষার ভিন্নতা, নতুন পরিবেশ, সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং সামাজিক ও আইনি কাঠামো সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাবে অভিবাসীরা নতুন ধরনের বৈষম্য ও অনিয়মের শিকার হন। পরে অনেকেই আবার কাঙ্ক্ষিত দেশের কঠোর অভিবাসননীতির কারণে স্বদেশে ফিরতে বাধ্য হন। প্রতিকূল পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার পরও নানা সামাজিক ও আর্থিক কারণ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা সহিংসতা এড়াতে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ পথে অভিবাসী হতে চান।

রাজনৈতিক সহিংসতা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ও বাংলাদেশ সরকারের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ৩১ হাজার ৪৩৯ জনকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। বাকিরা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। 

একদিকে রোহিঙ্গারা শরণার্থীশিবিরে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা এবং মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ বাড়ছে। এতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। 

স্থানীয় বাংলাদেশিদের পাশাপাশি শরণার্থীশিবিরের রোহিঙ্গাদের অনেকেই অবৈধ পথে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-২২ সালে ৮ হাজার ৩১২ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৮৯ জনের সলিলসমাধি হয়েছে। নিখোঁজও হয়েছেন অনেকে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত মানব পাচারবিষয়ক টিআইপির (ট্রাফিক ইন পারসন) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যম পর্যায়ে (টায়ার ২)। অর্থাৎ, মানব পাচার রোধে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা এখনো যথেষ্ট নয়। তবে সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বলে রাখা ভালো, সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রণীত শ্রম আইনে মানব পাচারকারী দেশগুলোকে নানা ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তি ও বিনিয়োগ থেকে বিরত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

তৈরি পোশাকশিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের বেশ ভালো অবস্থান রয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যদি মানব পাচারকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়, তাহলে বৈশ্বিক বাজারে আমাদের সেই অবস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বর্তমানে মানব পাচার ও নব্য দাসত্বমূলক বাণিজ্য ব্যবস্থার কারণে টিআইপি র‍্যাঙ্কিংয়ে মালয়েশিয়ার অবস্থানের অবনমন হয়েছে, যা সে দেশের আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অনেক ইউরোপীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেছে। 

বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা না কমলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মানব পাচারকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে। তাই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের (সিএমএস) একটি চলতি গবেষণায় রোহিঙ্গারা কেন অবৈধ পথে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে যেতে যাচ্ছেন এবং কীভাবে তাঁরা আশ্রয়শিবির ছেড়ে যাচ্ছেন, তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয়শিবিরের মাঝি, ভুক্তভোগী, স্থানীয় অংশীজন, যেসব রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে কারাভোগ করেছেন, পরে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন অথবা সমুদ্রপথে যাত্রা শুরুর পর মাঝপথে ফেরত এসেছেন, এমনকি বাংলাদেশিদের মধ্যে যাঁরা অবৈধভাবে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অবৈধ অভিবাসনের কারণ এবং কেন তা বাড়ছে, তা বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে।

অবৈধ অভিবাসনের যাত্রাপথ

রোহিঙ্গাদের অনেকেরই অভিবাসনের অবৈধ যাত্রাপথ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা নেই। তাই মালয়েশিয়ায় যেতে তাঁরা পুরোপুরি পাচারকারীদের ওপর নির্ভর করেন। মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রথমে কক্সবাজারের টেকনাফে নিয়ে যায় পাচারকারীরা। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের এই দলে নারী, শিশু ও নবজাতকের সংখ্যা বরাবরই চোখে পড়ার মতো। টেকনাফ থেকে সমুদ্রপথে নৌকায় করে অবৈধ অভিবাসীদের মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমান্তে নেওয়া হয়। পরে ছোট নৌকায় করে মিয়ানমারের সামিলা উপকূলে নেওয়া হয়। 

সমুদ্রে যাত্রাপথে ছোট্ট নৌকায় বিপুলসংখ্যক অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষকে গাদাগাদি করে তোলা হয়। এরপর সামিলা থেকে মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া যেতে অভিবাসীপ্রত্যাশীরা পাচারকারীদের অগ্রিম অর্থ দেন। টেকনাফে তাঁদের থেকে যে পরিমাণ অর্থ নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়, ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করা হয়। তখন অভিবাসীরা অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন। ফেরত আসা অভিবাসীদের ভাষ্যমতে, এভাবে মালয়েশিয়া যেতে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। 

দুর্বিষহ উদ্বাস্তুজীবন থেকে বাঁচার তাগিদ

মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যের রোহিঙ্গা সম্প্রদায় অনেক আগে থেকেই সরকার ও সামরিক বাহিনীর হাতে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হতো। নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। তাঁদের অনেকেই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে স্থানীয় বাংলাদেশি সমাজে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। পরে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে তাঁরা মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চলে যেতেন। তবে তখন তাঁদের অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন। শরণার্থীশিবিরে ক্যাম্পপ্রধান বা মাঝিদের বক্তব্য অনুযায়ী, অতীতে রোহিঙ্গারা শুধু অর্থনৈতিক কারণে বিদেশে যেতেন। কিন্তু এখন জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই সবচেয়ে বেশি অভিবাসন হচ্ছে। 

রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে শরণার্থীশিবিরে ছোট্ট জায়গায় ছয় থেকে আটজনের পরিবারকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পরিবারে অর্থ উপার্জনকারী সদস্য থাকেন মাত্র একজন। তাই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পরিবার চালাতে গিয়ে একধরনের চাপে থাকেন। স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদের কাজের কোনো স্বীকৃত ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা এখন ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় নেমে এসেছে। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় অনেকেই অভিবাসনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

সামাজিক কার্যক্রমের অনুপস্থিতি 

রোহিঙ্গা শিবিরে শরণার্থীদের জীবিকার জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো স্থানীয় সামাজিক কার্যক্রম চোখে পড়ে না। এতে তাঁরা একধরনের হতাশায় ভোগেন। অনেকেই নিজের অবস্থার পরিবর্তনে আশ্রয়শিবির ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 

সিএমএসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশে পালাতে পেরে প্রথম দিকে ভালো বোধ করেছিলেন। কিন্তু আশ্রয়শিবিরের ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সর্বোপরি জীবন নিয়ে তাঁর চরম হতাশা তৈরি হয়েছে। 

একজন গেলে অন্যদের ওপর চাপ

শরণার্থীশিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের কেউ অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যেতে পারলে, সেখানে বসবাসরত বাকিদের মধ্যে একধরনের চাঞ্চল্য তৈরি হয়। তাঁরা ক্যাম্প ছেড়ে বিদেশ যেতে প্রয়োজনে দালাল এবং মানব পাচারকারীদের শরণাপন্ন হন। পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিবার-পরিজন বা বন্ধুবান্ধবকে ব্যবহার করে। তাদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়ায় যেতে উদ্বুদ্ধ করে। অভিবাসন-পরবর্তী নানা প্রয়োজনে সহযোগিতার নিশ্চয়তা দেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। 

কিশোরীদের যৌতুক ছাড়া বিয়ের প্রলোভন

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে বাল্যবিবাহ ও যৌতুকপ্রথা এতটাই প্রচলিত যে যৌতুক ছাড়া কোনো বিয়ে হয় না। শুধু অর্থের অভাবে বিয়ের উপযুক্ত অনেক নারীর বিয়ে হয় না। সাধারণত, মেয়েদের বয়স ১৫ বা ১৬ পার হলেই যৌতুকের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মালয়েশিয়ায় যাওয়া রোহিঙ্গা পুরুষেরা মূলত এই সুযোগ কাজে লাগান। তাঁরা অল্পবয়সী মেয়েদের অভিভাবকদের বোঝান, তাঁদের সঙ্গে বিয়ে দিলে কোনো যৌতুক দিতে হবে না। পরে তাঁদের স্ত্রী নিরাপদে মালয়েশিয়া যেতে পারবেন। 

মালয়েশিয়ায় যাওয়া রোহিঙ্গা পুরুষেরা পূর্বপরিচিত হওয়ায় এবং যৌতুক না চাওয়ায় অল্পবয়সী মেয়েদের অভিভাবকেরা সহজেই এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। এভাবে তাঁরা নিজেদের মেয়ের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেন। অর্থাৎ নারীরা তাঁদের জীবন নিয়ে নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা পুরুষেরা শরণার্থীশিবিরে রেখে যাওয়া পরিবার-পরিজনের সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য অবৈধ পথে নেওয়ার চেষ্টা করেন। 

এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গারা ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অল্পবয়সী নারীদের মালয়েশিয়া যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। অনেকেই এই ঝুঁকি নিয়ে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফেরত আসেন। আর ঝুঁকি নিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ সমুদ্রপথে মারা যান। অনেক ক্ষেত্রে বেঁচে গেলে মিয়ানমারে তাঁদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সৌভাগ্যক্রমে কেউ মালয়েশিয়ায় যেতে পারলেও সুখের মুখ দেখেন না। সেখানে তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরিবারের সঙ্গে যেন কোনোভাবে যোগাযোগ করতে না পারেন, সে ব্যবস্থা করা হয়।

আশ্রয়শিবিরে নিরাপত্তাহীনতা

স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আশ্রয়শিবিরে স্থানীয় রোহিঙ্গা অপরাধী চক্রগুলোর মধ্যে মারামারি, খুনখারাবি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এতে সাধারণ শরণার্থীদের জীবনের ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত করে তোলে। আশ্রয়শিবিরে অহরহ অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটায় নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তায় অনেকেই মালয়েশিয়ায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। 

রোহিঙ্গাদের মানব পাচারের এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের একক সমস্যা নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসনের কারণে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মালয়েশিয়াও মানব পাচারকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়ার পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও অবৈধ পথে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে ওই সব দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। 

আসলে শুধু আইনি কাঠামো তৈরি করে রোহিঙ্গা অভিবাসন কমানো সম্ভব নয়। শক্তিধর ও বিবেকবান রাষ্ট্রগুলোকে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের যথাযথ মর্যাদায় স্বদেশে প্রত্যর্পণের ব্যবস্থা করতে হবে। সে দেশে তাদের নিরাপদ আবাসের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এতেই সব সমস্যার সমাধান নিহিত। তত দিন স্টিংয়ের গানের কথাগুলোর মতো আশায় থাকবে সাগরের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দেওয়া অভিবাসনেচ্ছু রোহিঙ্গারা।


মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন সিকদার, ইশরাত জাকিয়া সুলতানা, সেলিম রেজা, হাসান মুহাম্মাদ বেনীআমীনএস এন আজাদ শিক্ষক ও গবেষক, সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজ এবং কে এম নূর-ই-জান্নাত নদী গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।