বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস–পরীক্ষা বর্জন
ধর্ষকের বিচার দাবিতে সারা দিন বিক্ষোভে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশব্যাপী ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভে সারা দিন উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রোববার বেলা ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অন্তত ১২টি বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এর মধ্যে লাঠিমিছিল ও মশালমিছিল রয়েছে।
ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের নানা ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণাও দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে পোশাকের জন্য হেনস্তার শিকার হওয়ার পর নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন বিভাগ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার এক শিশুর সংকটাপন্ন অবস্থার খবর সামনে আসে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর আসতে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে রোববার বেলা ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, অপরাজেয় বাংলা, বটতলা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও কার্জন হল এলাকায় বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘উই ওয়ান্ট উই ওয়ান্ট/ জাস্টিস জাস্টিস’; ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস/ হ্যাং দ্য রেপিস্ট’; ‘আমার সোনার বাংলায়/ ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’; ‘আমার বোনের কান্না/ আর না আর না’; ‘রশি লাগলে রশি নে/ ধর্ষকদের ফাঁসি দে’; ‘ধর্ষকদের কালো হাত/ ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’; ‘২৪ এর বাংলায়/ ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’; ‘জাহাঙ্গীর করে কী/ খায় দায় ঘুমায় নাকি?’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা, ইংরেজি, লোক প্রশাসন, ভাষা বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, ভূতত্ত্বসহ আরও কয়েকটি বিভাগের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিবাদ–বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন।
পরে দুপুরে ধর্ষণবিরোধী লাঠিমিছিল ও রাতে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের পক্ষ থেকে একটি মশালমিছিল বের করা হয়। এ সময় ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ থেকে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়।
বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ক্লাস–পরীক্ষা বর্জন
ধর্ষণের প্রতিবাদ ও ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪টি বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা রোববার থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই বিভাগগুলো হলো লোক প্রশাসন, রসায়ন, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান, পদার্থ, পরিসংখ্যান, ভূতত্ত্ব, ইংরেজি, ভাষা বিজ্ঞান, বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তথ্য গ্রন্থাগার ও ব্যবস্থাপনা, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মার্কেটিং, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মুদ্রণ ও প্রকাশনা, সংগীত, ম্যানেজমেন্ট, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, পদার্থ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন, ইএসওএল, গণিত, পরিসংখ্যান বিভাগ।
যেভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের
গত শনিবার মধ্যরাতে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এদিন রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরে একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে যোগ দেন। তাঁরা রাত আড়াইটা পর্যন্ত রাজু ভাস্কর্যের সামনের রাস্তায় বসে অবস্থান নেন এবং ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। সেখান থেকে সারা দেশে চলমান ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনার দ্রুত বিচারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ তাৎক্ষণিকভাবে দুটি দাবি জানায়। সেগুলো হলো ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং ধর্ষকদের প্রকাশ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি। পরে মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দায়ীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে তোলার জন্য আলটিমেটাম দিয়ে সেদিনের মতো কর্মসূচি শেষ করেন শিক্ষার্থীরা।
ধর্ষণবিরোধী মঞ্চের পাঁচ দফা
রোববার রাত পৌনে ১০টার দিকে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ থেকে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের মুখপাত্র আশরেফা খাতুন।
প্রথম দুটি দাবি ঘোষণা করেন আশরেফা। উমামা ফাতেমা বাকি তিনটি দাবি তুলে ধরেন।
দাবিগুলো হলো: ১. মাগুরায় শিশু ধর্ষণের মামলার বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা, এক মাসের মধ্যে ধর্ষকের বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত এবং বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালে ওই শিশুর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ২. প্রতিটি ধর্ষণ মামলার বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত মামলার বিচার কার্য সম্পন্ন করে সব ধর্ষণ–কাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং তিন কার্যদিবসের মধ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ৩. নারী ও শিশুর নিরাপত্তার প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে জবাবদিহি করতে হবে। ৪. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে ‘নারী ও শিশু নিপীড়নবিরোধী সেল’ গঠন ও সেলের কার্যকরিতা নিশ্চিত করতে হবে। সারা দেশে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৫. ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সাইবার বুলিং’–সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করে অপরাধের স্পষ্ট ও যথাযথ সংজ্ঞায়ন করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি
রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সমাবেশ থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগ নয় বরং পদচ্যুতির দাবি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনিম সিরাজ মাহবুব।
এরপর দুপুরে লাঠিমিছিল থেকেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর আগে শনিবার মধ্যরাতে হল থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা নারীদের নিরাপত্তা দিতে ‘ব্যর্থ’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
দুপুরে অপরাজেয় বাংলার সামনে নারীর ওপর সহিংসতার প্রতিবাদে সমাবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, ২০০৫ সালে একটি শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে তাকে যে ধর্ষণ করা হয়েছিল, যে করেছিল সে কিন্তু এখন জেল থেকে বের হয়ে গেছে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, নির্যাতন শুধু ঘটতে দেওয়া হচ্ছেই না, যাদের এটা থামানের কথা, তাঁরা চোখ বন্ধ করে আছে।
দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখানে ঢাকা মেডিকেলের অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, যারা ধর্ষণ করে এবং যারা এদের মদদ দেয়, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, দেশে চলমান এসব ধর্ষণের সুরাহা হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ বিষয় সচেতন হতে হবে। তাদের নেতা–কর্মীদের সচেতন করতে হবে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
রাতে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ থেকে উমামা ফাতেমা বলেন, ‘বাংলাদেশের আপামর জনগণের উদ্দেশে ছাত্রদের পক্ষ থেকে বলতে চাই, ধর্ষণ ও নিপীড়ন বন্ধে আপনারা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আপনারা অপরাধীদের আইনের হাতে সোপর্দ করুন এবং তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করুন।’
এর আগে দুপুরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার তামান্না বলেন, ‘আমি জন্মের পর এখন পর্যন্ত কোনো ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে দেখিনি। যার ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন ধর্ষকের জন্ম হচ্ছে। তারা ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনায় ভয় পাচ্ছে না। আজকের সমাবেশ থেকে আমরা ক্লাস-পরীক্ষা বয়কট ঘোষণা করছি। আমরা এ ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব না।’