‘আম্মু, তোমাকে ভালোবাসি’, ডেঙ্গুতে মৃত মাকে ছোট্ট আইয়ানের চিঠি

আইয়ান তিহান
ছবি: পরিবারের কাছে পাওয়া

আইয়ান তিহানের বয়স পাঁচ বছরের কাছাকাছি। স্কুলে যায়। তবে এখনো লেখা শেখেনি। কিন্তু আইয়ান চিঠি লিখতে চায় তার মাকে। বড় বোন ফাতিহা রিদ্বীনকে (১২) দিয়ে একটি চিঠি সে লিখিয়েছেও।

মায়ের উদ্দেশে কী লিখিয়েছে আইয়ান? লিখিয়েছে, ‘আম্মু, তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে খুব “মিস” করি।’

আইয়ানের মা ফারজানা শারমিন গত বছরের ২৫ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর ডেঙ্গু হয়েছিল। তিনি ছিলেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা।

আলপনা করা রঙিন কাগজে লাল রঙের ‘হার্ট’ চিহ্ন আঁকা চিঠিটি খামে ভরে আলমারিতে রেখে দিয়েছে ফাতিহা
ছবি: পরিবারের কাছে পাওয়া

ফাতিহা ও আইয়ানের বাবা দৈনিক সমকালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জাহেদুল আলম ফেসবুকে এ চিঠির কথা লিখে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, আলপনা করা রঙিন কাগজে লাল রঙের ‘হার্ট’ চিহ্ন আঁকা চিঠিটি খামে ভরে আলমারিতে রেখে দিয়েছে ফাতিহা।

আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ফাতিহা ও আইয়ান নানাবাড়িতে যাবে। সেখানে তাদের মায়ের করব। নানাবাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া গ্রামে। জাহেদুল আলম বলেন, মায়ের কবরে চিঠিটি রেখে আসতে চায় ফাতিহা ও আইয়ান।

দেশে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে যে ১ হাজার ৭০৫ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁদের একজন ফারজানা।

মাকে লেখা চিঠি
ছবি: পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া

ডেঙ্গুতে গত বছর কোনো শিশু মা হারিয়েছিল, কেউ বাবা হারিয়েছিল, কেউ সন্তান হারিয়েছিলেন, কেউ হারিয়েছিলেন স্বজন।

মশা মারতে কার্যকর উদ্যোগের অভাব, অকার্যকর ওষুধের ব্যবহার, যথেষ্ট বরাদ্দ না থাকা, সমন্বয়হীনতা, চিকিৎসার সংকট—নানা দিক তখন সামনে এসেছিল। বিভিন্ন দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে তখন দেখা গিয়েছিল, ডেঙ্গুতে বাংলাদেশেই মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।

ফাতিহা ও আইয়ানকে এখন আর মা খাইয়ে দেন না, মায়ের পাশে তারা ঘুমাতেও পারে না। তবু জীবন কাটছে।

জাহেদুল আলম প্রথম আলোকে জানান, ফাতিহা রাজধানীর বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। একই স্কুলের নার্সারিতে পড়ছে আইয়ান। সন্তানদের নিয়ে তিনি রাজধানীর কাঁঠালবাগানে বাস করেন। একই ভবনে ফাতিহা ও আইয়ানের একজন খালা থাকেন। তারা খালার কাছ থেকে সহায়তা পায়।

আরও পড়ুন
ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াইয়ে হার মেনে বিদায় নিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা ফারজানা শারমিন
ছবি: পরিবারের কাছে পাওয়া

বাসাটিতে ফারজানার ছবি, ব্যবহার করা জিনিসপত্র—সব আগের মতোই আছে। শুধু জাহেদুল আলম ও তাঁর দুই সন্তানের রোজনামচা পাল্টে গেছে। জাহেদুল বলেন, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়া, ঘুম পাড়ানো, ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কাজ তিনিই করেন। বাসায় একজন পুরোনো সহকারী রয়েছেন, তিনি ঘরের কাজে সহায়তা করেন।

ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেছিলেন ফারজানা। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করতেন জাহেদুল আলম। পড়াশোনার সূত্রে দুজনের পরিচয়, প্রেম ও বিয়ে।

ফারজানার মৃত্যুর পর গত বছরের ২৭ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনে ‘মাকে কেন নতুন সাদা কাপড়ে মোড়ানো হলো, জানতে চায় ছোট্ট আইয়ান’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

জাহেদুল আলম বলেন, ফাতিহা ও আইয়ান মাকে নিয়ে এখন আর সবার সামনে তেমন কোনো কথা বলে না। হয়তো তারা নিজেদের মতো করেই মাকে মনে করে।

ডেঙ্গু এবারও ‘ভয়ের কারণ হবে’

স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে এখন আর এমন আনন্দভ্রমণে বের হন না জাহেদুল আলম
ছবি: পরিবারের কাছে পাওয়া

সরকারি হিসাব বলছে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ৮৪৯ জনের। শুধু ২০২৩ সালে মারা যান আগের ২২ বছরের দ্বিগুণসংখ্যক মানুষ।
এবার মশা পরিস্থিতি কেমন, তা বুঝতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কয়েকটি এলাকাসহ সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মশা পর্যবেক্ষণের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে ৭ থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত এই জরিপ চালানো হয়।
জরিপে দেখা যায়, গত জানুয়ারিতে এসব এলাকায় প্রতিটি ফাঁদে গড়ে মশা ছিল ৩০০টি। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৩৮৮টি। মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ৪২০টি। এই হিসাবে জানুয়ারির তুলনায় মার্চে কিউলেক্স মশার পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

ডেঙ্গু হয় এডিস মশার কামড়ে। এডিস মশার পরিস্থিতি জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা মারতে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুতে এ বছরও অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

১৯ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত ‘ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব হ্রাসকরণ ও চিকিৎসাসেবা সুসমন্বিতকরণ’ বিষয়ে সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন ও শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, এবার বছরের শুরুতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

বাসায় মশা দেখলেই ফাতিহা ও আইয়ান আতঙ্কিত হয়ে পড়ে জানিয়ে স্ত্রীকে হারানো জাহেদুল আলম বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের মতো ভুক্তভোগী পরিবার এবং মৃত্যুর একেকটি সংখ্যা বাড়বে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোই বুঝতে পারছে স্বজন হারানোর বেদনা।’