শীতে গরম পানিতে দগ্ধ শিশুর ভিড় হাসপাতালে

গরম পানিতে দগ্ধ হচ্ছে অনেক শিশু। অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলছেন চিকিৎসকেরা।

দুই বছর বয়সী হিয়ামণিকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের ড্রেসিং করার কক্ষে ঢুকেছেন মা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন শিশুটির বাবা ও আট বছর বয়সী ভাই। বাবা বারবার আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমার মেয়েটা পুড়ে শেষ!’ গতকাল বুধবার রাজধানীর শুক্রাবাদের বাসায় হিয়ামণিকে গোসল করানোর জন্য মা গরম পানি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে তাতে ঠান্ডা পানি মেশাচ্ছিলেন।

ওই সময় ডেকচি থেকে গরম পানি ছলকে হিয়ামনির মাথা থেকে পুরো দেহ পুড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হিয়ামণিকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে ছুটে আসেন।

গতকাল দুপুরে জরুরি বিভাগে হিয়ামণির মতো কয়েক শিশুর দেখা পাওয়া গেছে, যারা গরম পানিতে পুড়ে গেছে। আরাবি নামের দুই বছরের এক শিশুকে নিয়ে উত্তরা থেকে এসেছে একটি পরিবার। শিশুটির মা ও দুই ফুপু কাঁদছিলেন। ফুপু নিলুফার ইয়াসমিন জানান, আরাবির মা রান্নাঘরে গরম পানির হাঁড়ি নামানোর সময় অতর্কিতে আরাবি মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ওই সময় হাঁড়ি থেকে পানি পড়ে আরাবি দগ্ধ হয়।

সারা বছরই গরম পানিসহ উত্তপ্ত তরলে দগ্ধ হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। তবে শীতকালে গরম পানিতে দগ্ধ মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
মো. তরিকুল ইসলাম, আবাসিক সার্জন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট

চিকিৎসকেরা বলছেন, শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে গরম পানিতে শিশুদের দগ্ধ হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। জুন মাসে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গরম পানিসহ গরম চা, দুধ, তরকারি, ডাল, ভাতের মাড় ইত্যাদি উত্তপ্ত তরলে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৬২ জন। আর অক্টোবরে ৫২৬ জন ও নভেম্বরে ৪৫৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। হরতালের কারণে নভেম্বরে রোগী তুলনামূলক কম ছিলেন বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।

শীতে শিশু রোগীর সংখ্যা বেশি

জরুরি বিভাগের ১১ নম্বর শয্যায় মামির কোলে হেলান দিয়ে শুয়ে কাঁদছিল ছয় বছরের ফাতেমা আক্তার। শরীরের ওপরের অংশ ব্যান্ডেজে মোড়া। মা পেয়ারা বেগম বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় তাঁদের বাড়ি। শীতে মেয়েকে গরম পানি দিয়ে গোসল করান। রোববার রান্নাঘর থেকে গরম পানি নিয়ে বের হচ্ছিলেন। ওই সময় পাশের ঘর থেকে দৌড়ে বের হয় ফাতেমা। ধাক্কা লেগে তাঁর হাত থেকে গরম পানির হাঁড়ি পড়ে ফাতেমার ডান হাত, বুক ও মুখের বাঁ পাশ পুড়ে যায়। গত মঙ্গলবার তাঁরা জরুরি বিভাগে এসেছেন।

আরও পড়ুন

আশুলিয়া থেকে গতকাল সকালে দুই বছরের আজানকে নিয়ে আসে তার পরিবার। মা আকলিমা বলেন, দাদি গরম পানির ব্যাগ দিয়ে কোমরে সেঁক দিচ্ছিলেন। ওই সময় খেলতে খেলতে আজান ব্যাগের ওপর পড়লে ব্যাগ ফেটে দাদি ও নাতি দুজনই দগ্ধ হন।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে এ বছরের জুন মাসে মোট যতসংখ্যক পোড়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছিলেন, তার প্রায় কাছাকাছি সংখ্যক রোগী অক্টোবরে শুধু গরম পানিতে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। জুন মাসের তুলনায় অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। অর্থাৎ গরম পানিতে দগ্ধ শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় মোট রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে।

জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছরই গরম পানিসহ উত্তপ্ত তরলে দগ্ধ হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। তবে শীতকালে গরম পানিতে দগ্ধ মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। শিশু রোগীদের অধিকাংশই গরম পানিতে দগ্ধ। অনেকে মুঠোফোন চার্জ দেওয়া শেষে সুইচ বন্ধ করেন না। ওই চার্জার মুখে দিয়ে শিশুর মুখ পুড়ে যায়। অনেকে পর্দা ধোয়ার পর পর্দা ঝোলানোর রড এক কোনায় রেখে দেন। শিশুরা ওই রড নিয়ে বারান্দা বা জানালার কাছে গিয়ে খেলে। ওই রড গ্রিলের বাইরে বিদ্যুতের তারে লেগেও দগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো শিশুর হাতও কেটে ফেলতে হয়েছে।

এ ছাড়া গরম ডালের হাঁড়ি উল্টে কামরাঙ্গীরচরের ৬ বছরের মিনহাজ এবং পুরান ঢাকার ১৫ মাসের নিবেদিতা রায় গরম তরকারির বাটিতে হাত ডুবিয়ে দগ্ধ হওয়ায় তাদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আনা হয়েছে।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, মানিকগঞ্জ থেকে দুই বছরের ফরিদকে নিয়ে আসা হয়েছে। ছয় দিন আগে সে গরম ভাতের হাঁড়ি উল্টে দগ্ধ হয়। প্রতিবেশী মো. সেলিম বলেন, শিশুটির দরিদ্র মা–বাবা এই হাসপাতালের খোঁজ জানতেন না। তিনি নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসক এখানে শয্যা খালি নেই জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যেতে বলেছেন তাঁদের।

শিশুকে যেভাবে রক্ষা করবেন

হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ গতকাল তাঁর কক্ষে প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের পোড়া রোধে অভিভাবকদের সচেতন হওয়াই বেশি জরুরি। গোলাকৃতির হাঁড়ি একটু ধাক্কায় সহজে উল্টে যায়। চ্যাপ্টা ধরনের হাঁড়ি ব্যবহার করা উচিত। আর রান্না করার পর গরম হাঁড়ি কখনো মেঝেতে না রেখে উঁচু স্থানে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা দরকার। গরম পানির হাঁড়ি বাথরুমের দিকে বহন না করে বালতি রান্নাঘরে এনে তাতে গরম পানি ঢালা উচিত। এতে ঝুঁকি কমে। গ্রামে মাটির চুলায় রান্নার পর জ্বলন্ত কাঠ নিভিয়ে ফেলা, শীতকালে পাতা পুড়িয়ে আগুন পোহানো থেকে শিশুদের দূরে রাখা, এ সময় নতুন ধান সেদ্ধ ও তুষের আগুন থেকে শিশুদের দূরে রাখা প্রয়োজন।