সংস্কারের উদ্দেশ্য ভালো না হলে তার ভবিষ্যৎ নেই: রেহমান সোবহান
অতীত অভিজ্ঞতার ওপর দৃষ্টিপাত করে রাষ্ট্র সংস্কারের পরিকল্পনার চেয়ে তা বাস্তবায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। আবার সংস্কারের উদ্দেশ্য যদি ভালো না হয়, তাহলে তার ভবিষ্যৎও থাকবে না বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা এবং তা পূরণের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে আজ রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে সংস্কার নিয়ে কথা বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের ‘রিফর্ম ট্র্যাকার’ উদ্বোধন উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। অনুষ্ঠানে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা চলে। এরপর সমাপনী বক্তব্য দেন রেহমান সোবহান।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। সেই লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে জুলাই সনদ। সংবিধানসহ রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটও হবে।
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহমান সোবহান বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে সবকিছুই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে। বাস্তবে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা হলো বাস্তবায়নের ব্যর্থতার ইতিহাস। তিনি জোর দিয়েই বলেন, যত সংস্কার প্রস্তাবই টেবিলে রাখা হোক না কেন, যদি উদ্দেশ্য ভালো না হয়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধই হবে।
এ সময় সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে ফেরার পর্বে ১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নিজের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশন (ইসি), এমনকি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সংস্কার করিনি। আমরা তখন অস্ত্রধারী লোকদের কাছ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করতে পারিনি। সবকিছুই নির্ভর করেছিল প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সৎ উদ্দেশ্যের ওপর।’
উদ্বোধন হয়েছে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের ‘রিফর্ম ট্র্যাকার’। এই ওয়েবসাইটে সংস্কারের খাতভিত্তিক বিস্তারিত তথ্য, সংস্কারবিষয়ক নথি ও দলিল, কোন সংস্কারের কতটুকু বাস্তবায়ন হলো, সংস্কারের অগ্রগতি পর্যালোচনা—এসব তথ্য পাওয়া যাবে।
সেই অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরাও স্বাধীনভাবে নির্বাচিত ছিলেন না জানিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক জোট দ্বারা মনোনীত ছিলেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার সততা ও একাগ্রতা ছিল বলেই সম্ভবত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা গিয়েছিল; যেখানে বন্দী থাকা সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদও তাঁর দল নিয়ে নির্বাচন করতে পেরেছিলেন এবং পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিতও হয়েছিলেন।
অনুষ্ঠানে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের ‘রিফর্ম ট্র্যাকার’ উদ্বোধন করা হয়। এটি মূলত একটি ওয়েবসাইট (ঠিকানা: reformtracker.bdplatform4sdgs.net)। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়াকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। সংস্কারের খাতভিত্তিক বিস্তারিত তথ্য, সংস্কারবিষয়ক নথি ও দলিল, কোন সংস্কারের কতটুকু বাস্তবায়ন হলো, সংস্কারের অগ্রগতি পর্যালোচনা—এসব তথ্য পাওয়া যাবে এই ওয়েবসাইটে। খাতভিত্তিক সংস্কারের তথ্য পেতে সাবস্ক্রাইব করার সুযোগ, মতামত দেওয়ার সুযোগ এবং কি-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করার সুবিধাও থাকবে। এসডিজিবিষয়ক নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এই উদ্যোগকে ‘সংস্কারের উইকিপিডিয়া’ হিসেবে সামনে আনতে চাইছে।
এই রিফর্ম ট্র্যাকারের গুরুত্ব তুলে ধরে রেহমান সোবহান বলেন, এটি এমন একটি উপায়, যার মাধ্যমে নাগরিক সমাজের স্তর থেকে দেখাতে পারি যে নির্বাচিত সরকার ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে জবাবদিহির মধ্যে রাখার আরও পদ্ধতি আছে। এটি নাগরিক সমাজের একটি সক্রিয় ভূমিকা।
আমরা নির্বাচন কমিশন, এমনকি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সংস্কার করিনি। আমরা তখন অস্ত্রধারী লোকদের কাছ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করতে পারিনি। সবকিছুই নির্ভর করেছিল প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সৎ উদ্দেশ্যের ওপর।অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, ১৯৯০ সালের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে
এই উদ্যোগের সময়কাল এখন থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত হবে বলে জানান তিনি। কারণ সংস্কারের কম বিষয়ই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে বাস্তবায়ন হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, বর্তমান সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তাদের শুরু করা অধিকাংশ কাজকেই আইনে পরিণত করতে হবে এবং এরপর ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এসবই সময়সাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়া।
এই প্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখতেও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আরও অনেক বেশি সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। সংস্কারপ্রক্রিয়া কতটা এগোচ্ছে, তার ওপর নজর রাখতে নাগরিক সমাজের একটি সক্রিয় জোট গঠনের পরামর্শ তিনি দেন।
আবার নাগরিক সমাজের কার্যক্রমের ওপর নিবিষ্ট মনোযোগ রাখা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ কতটা আন্তরিক এবং তারা একটি শাসনের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের রূপ নিতে পারছে কি না, তা দেখার জন্য এটা প্রয়োজন। কারণ বাস্তবিক অর্থে বহু বছর ধরে তারা কার্যকর গণতন্ত্র ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের জন্য যে পূর্ণ দায়িত্ব পালন প্রত্যাশিত, তা উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বের পাশাপাশি সঞ্চালনা করেন।
আলোচনায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন ও কামরান ত. রহমান, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান, মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এমআরডিআই) নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান, সিপিডির অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা) তৌফিকুল ইসলাম খান।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের উপ-আবাসিক প্রতিনিধি সোনালি দয়ারত্নে। বিশেষ অতিথি ছিলেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর।