অ্যান্টিবডি তৈরি বিরাট আশার আলো

করোনাভাইরাস নিয়ে এখন অনেক অশান্তি। আতঙ্কিত পৃথিবী। নানা প্রশ্ন আসছে, কিন্তু এখনো কোনো উত্তর নেই। প্রয়োজন সত্যিকারের তথ্যের আর তা জেনে নিজ অবস্থার বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে সঠিক পন্থা নির্ধারণের। পৃথিবীতে এই ভাইরাসের আক্রমণ প্রথম। তাই প্রতিদিনই নতুন কিছু জানার আছে।

যেসব দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে বেশ সফল হয়েছে, তারা সবাই প্রথমে রোগ শনাক্ত করার পর আক্রান্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের কোয়ারেন্টিনে নিয়েছে। ফলে সংক্রমণ অনেকাংশে কমে গেছে। এটি সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে, বিশেষ করে মোবাইল ফোনের অ্যাপসের মাধ্যমে সংস্পর্শে আসা মানুষদের খুঁজে বের করে। তা না হলে দেশের সব মানুষকে পরীক্ষা করতে হবে অথবা সবাইকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ তখন বিকল হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্য বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এখন তা-ই করার চেষ্টা করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এতে কোনো সাহায্য না করলেও অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব অর্থে তারা এগিয়ে যাবে।

পুরো যুক্তরাষ্ট্র লকডাউন করার পর অর্থনীতিকে সচল করতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই মে মাসের শুরুতে সবকিছু খুলতে চাচ্ছেন। এতে অনেকে আপত্তি জানিয়েছেন। ডা. অ্যান্থনি ফাউচি মনে করেন, নতুন অ্যান্টিবডি টেস্ট ব্যবহার করে দেখা যেতে পারে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। যারা করোনাভাইরাসে মৃদু আক্রান্ত হয়ে সেরে গেছেন, তাঁদের শরীরে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। ফলে তাঁরা আর সংক্রমিত হবেন না। ঠিক টিকা দিলে যেমন রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করা হয়। এসব মানুষ কাজে যোগ দিতে পারবেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্ভয়ে করোনা রোগীদের সেবা দিতে পারবেন।

বর্তমান পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয়। যদিও ৩০ ভাগ সময়ে পরীক্ষা ভুল হয় এবং রোগ থেকেও নেই দেখাতে পারে। অনেক সময় কর্মীরা ভয়ে কাঠিটা নাকের গভীরে না নিয়ে বাইরে থেকে দায়সারা টেস্টের স্যাম্পল নিলে তাও নেগেটিভ আসবে। তা ছাড়া সময়, ব্যয় ও টেকনিক্যাল কারণে পিসিআর টেস্ট বিশাল পরিসরে করা হয়তো সম্ভব হবে না। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই করিয়ে নেওয়া উচিত। তবে পরীক্ষায় নেগেটিভ এলেও যদি উপসর্গ থাকে, তবে উপসর্গকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। তাই সাধারণ মানুষ করোনার উপসর্গ দেখলেই নিজেরাই আলাদা হয়ে নিকটজনদের সংস্পর্শে না এসে কোয়ারেন্টিনে যাবেন। এটি শুধু সরকারকে দেখানোর জন্য নয়, এটি আত্মমর্যাদা রেখে নিজেদেরও বাঁচার উপায়। সবার জানা দরকার, করোনা ৮০ ভাগ সময়ই কোনো ক্ষতি করে না। আর যদি আরেকজনের কাছে না ছড়াতে পারে, তবে আপনা-আপনি তা আপনার শরীরের ভেতর দুই সপ্তাহের মধ্যেই মরে যায়।

আজকাল করোনা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জন্য কিছু দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। করোনা অ্যান্টিবডি হচ্ছে ছোট ইমিউনোগ্লোব্যুলিন (immunoglobulin বা ig) প্রোটিন, যা যেকোনো ইনফেকশন প্রতিরোধে শরীরে তৈরি হয়, নিজেকে রক্ষার তাগিদে। করোনা ঢুকলে শরীর এই অ্যান্টিবডি তৈরি করে পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে। দুই ধরনের অ্যান্টিবডি হয় যেমন—igG ও igM । igM অ্যান্টিবডি তৈরি হয় কিছুদিনের মধ্যেই। আর igG তৈরি হয় সাধারণত অনেক পরে, যার উপস্থিতির অর্থ হচ্ছে এই রোগের প্রতিরক্ষা তৈরি হয়েছে শরীরে। শুধু igM থাকলে বা দুটিই থাকলে মনে করা হয় যে, সংশ্লিষ্ট রোগটির সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। আর শুধু igG থাকলে ধরে নেওয়া হয়, ইনফেকশন চলে গেছে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে এই পরীক্ষা দিয়ে দুটি জিনিস দেখার চেষ্টা চলছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার কোথায় কতটুকু হয়েছে, এর প্রতিরোধে কোথায় কত দিন লকডাউনের মতো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তা নিরূপণে দ্রুত ও কম খরচে অ্যান্টিবডি টেস্ট একটি কার্যকর পদ্ধতি। কারও শরীরে যদি শুধু igG পাওয়া যায়, তবে তাদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সরকার পরীক্ষাটির অনুমোদন দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি সংকট হচ্ছে, আগে কারও সার্স হয়ে থাকলে, তার শরীরে এই অ্যান্টিবডি আগে থেকেই থাকার কথা। তাই এমন কারও শরীরে এ অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও তার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আজকের মধ্যে এই টেস্টটি বাংলাদেশেই কম খরচে তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। টেস্টের প্রাথমিক কার্যকারিতা পরীক্ষার পর এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে। আমরা আশা করব, দেশের এই দুর্যোগে প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে এই টেস্টকে শিগগিরই জনস্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন দেবেন। লকডাউন প্রত্যাহার এবং সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকদের কাজে ফিরে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুনর্জাগরণে এ ধরনের টেস্টকে কাজে লাগানো যাবে। তা ছাড়া ভালো হওয়া অ্যান্টিবডি থাকা রোগীদের প্লাজমা নিয়ে জটিল ও অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।

করোনা প্রতিরোধে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কমপক্ষে দু সপ্তাহের আইসোলেশন বা অন্তরীণ থাকা দরকার এবং নতুন রোগীর সাহচর্যে এলে আরও দুই সপ্তাহ করে অন্তরীণ থাকা দরকার। উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে একটি ঘরে সম্পূর্ণ আলাদা করে দুই সপ্তাহে সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। মাস্ক পরা, ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান দিয়ে সবার হাত ধোয়া, রোগী নিজের বাথরুম নিজে পরিষ্কার করবেন। কারণ, বাথরুম ফ্ল্যাশ করলে মল থেকে ভাইরাস বাতাসে ছড়াতে পারে। অ্যাপার্টমেন্টে থাকার জন্য কিছুটা অসুবিধা হলেও তা মেনে নেওয়া দরকার। কারণ, এখন সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে নিজের পরিবারের ভেতর।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন করোনা পজিটিভ হলেও শ্বাসকষ্ট না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বাসায় থাকতে বলা হচ্ছে এবং কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। এ সময়ে বেশির ভাগ রোগী ভালো হয়ে যায়। আবার অনেকে অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে যায়। এ সময়ে টেস্ট পজিটিভ হলে চিকিৎসকেরা ওষুধ দিতে পারেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা দেওয়া সমীচীন।

বাংলাদেশে করোনা কতটুকু ছড়াবে বা ক্ষতি করবে, সে সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই। সাধারণ মানুষের জন্য লকডাউন পুরোপুরি সম্ভব না হলেও এখন সরকার, মিডিয়া, বেসরকারি সংস্থা ও জনগণ বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে। তবে এত দিনে সত্যি অনেক ছড়িয়ে গেলে আগামী চার সপ্তাহে মৃত্যুহার একটি ধারণা দিতে পারে। গ্রামগঞ্জে সচেতনতার কারণে সন্দেহজনক সব মৃত্যুসংবাদ এখন পাওয়া যাচ্ছে। উপসর্গ নেই এমন মানুষের ভেতর অ্যান্টিবডি তৈরি হলে বা পুরোনো অন্য কোনো করোনাভাইরাস পরিবারের থেকে অ্যান্টিবডি থাকলে মানুষ কম আক্রান্ত হতে পারে। তবে গরম পড়লে করোনা দুর্বল হয়ে যাবে—এসব আশাবাদ গুরুতর বিপদ ডেকে আনতে পারে।

নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি সবাইকে তৈরি থাকতে হবে। ইদানীং সিলেটে বেসরকারি চিকিৎসক সমিতি ও মেয়রের উদ্যোগে সরকারি চিকিৎসক, হাসপাতাল, বিএমএ কর্মকর্তাসহ অন্যরা একত্র হয়ে একটি পরিকল্পনা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। তাদের রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে এই উদ্যোগ কার্যকর করা গেলে তা জাতীয় পর্যায়েও গ্রহণ করা যেতে পারে। এই দুঃসময়ে দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানবতার খাতিরে কাজ করার এক মহান সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের সামনে।

চিকিৎসার ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে বর্তমানে দুই শতাধিক গবেষণা চলছে। দুই দিন আগে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশ মিলে remdesivir (ভাইরাসবিরোধী ওষুধ) ওষুধের ওপর গবেষণা করছে। গবেষণাটি শেষ হওয়ার আগেই এর ব্যবহারের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফল জানানো হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ৬১ জন রোগীকে ১০ দিন এই ওষুধ দেওয়ার পর ৬৮ ভাগ রোগীর বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে। বেশির ভাগ রোগী (৬৪ শতাংশ) ভেন্টিলেটরে ছিলেন। ওষুধটি দেওয়ার আগে ১২ দিনের মতো তাঁরা অসুস্থ ছিলেন। প্রথম ডোজ ওষুধ দেওয়ার পর গড়ে ১৮ দিনের মাথায় তাঁদের উন্নতি দেখা যায়। ৭৫ ভাগ রোগী যাঁরা ভেন্টিলেটরে ছিলেন, তাঁদের উন্নতি ছিল লক্ষণীয়। তবে বেশি উন্নতি হয় ভেন্টিলেটরে ছিলেন না—এমন রোগীদের। ১৩ শতাংশ রোগী ওষুধটি নেওয়ার পরও মারা যান। ৬০ ভাগ রোগীর শরীরে ওষুধের কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়।

কিছুদিন আগে lopinavir-ritonavir (kaletra) ট্রায়াল দেওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, ওষুধটি নেওয়ার চেয়ে না, না নিলে মৃত্যুহার কম থাকে। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও মৃত্যুহার ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। ওই ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী রোগীরা তুলনামূলক কম অসুস্থ ছিলেন। তাঁদের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ভেন্টিলেটরে ছিলেন। জাপানি ওষুধ favipiravir (avigan) নিয়ে আশাবাদ রয়েছে। তবে এর ভালো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনো হয়নি। যদিও চীনের উহানে রোগীদের ওষুধটি দেওয়ার পর বলা হচ্ছে, ওষুধটি মৃদু ও মধ্যম উপসর্গ থাকা রোগীদের জন্য বেশ কার্যকর ও কম ক্ষতিকর। জাপানিরা তাই উৎসাহিত হয়ে আগামী জুনের মধ্যে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করবে এবং অনেক দেশে মানবিক কারণে সেটা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাপানিরা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানে, বেশি অসুস্থ করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এটি কাজ করেনি।

চীনে এই মহামারির সময় তারা পাঁচ হাজার ওষুধ পরীক্ষা করেছে এবং পরিশেষে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, Remdesivir, lopinivir আর Favipiravir ওষুধগুলোকে আরও পরীক্ষার জন্য সুপারিশ করেছে। আরও বিভিন্ন ওষুধ পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ল্যাবে তৈরি অ্যান্টিবডি, ভালো হওয়া রোগীর অ্যান্টিবডি প্লাজমা ইনফুসিওন, স্টেম সেল থেরাপির প্রাথমিক ভালো খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ইদানীং অনেক রোগীর পালমোনারি এমবোলাস বা ফুসফুসে রক্ত জমাট হচ্ছে, যা নিউইয়র্কের চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলছে। তা ছাড়া ডায়ালাইসিসের সময় মেশিনেও রক্ত জমাট হচ্ছে এবং হেপারিন দিয়েও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেক রোগী দেখতে ভালো হওয়ার পরও হঠাৎ খারাপ হয়ে যাচ্ছেন এবং কিছু করার আগেই মারা যাচ্ছেন। এটিকে অনেকে বলছেন সাইটোকাইন স্টর্ম বাই ওভার অ্যাকটিভ ইমিউন সিস্টেমের জন্য দায়ী। আবার অনেকে করোনার জন্য হার্টে সমস্যা অথবা ওষুধের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত। বিচলিত চিকিৎসকেরা নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে চিকিৎসা দিচ্ছেন এবং অনেক কিছুই এরই মধ্যে উদ্ভাবনও করছেন। ইদানীং নিউইয়র্কের বাংলাদেশি চিকিৎসক মোহাম্মদ আলম হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের সঙ্গে এজিথ্রোমাইসিন না দিয়ে ডক্সিসাইক্লিন দিয়ে ভালো ফল পেয়েছেন এবং হার্টের ওপর ওষুধের অথবা করোনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে পেরেছেন বলে বিশ্বাস করছেন। করোনার জন্য সবাই অস্থির। তথাপি স্বাভাবিক কারণেই প্রবাসীরা ঘোরতর বিপদের মধ্যেও বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

*লেখক: চিকিৎসক