আইসিইউ ফাঁকা পাওয়া এখন ‘ভাগ্যের’ বিষয়

ফাইল ছবি।

করোনায় আক্রান্ত এক আত্মীয়ের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) একটি শয্যা খুঁজছিলেন রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসিন্দা মো. রিয়াদ। দুপুর পর্যন্ত ১১টি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে কোথাও আইসিইউ ফাঁকা পাননি। বিকেলের দিকে খোঁজ পান মগবাজারের একটি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা হয়েছে। খবরটি শোনা মাত্রই দেরি না করে গ্রিন রোডের বাসা থেকে ওই আত্মীয়কে নিয়ে সেখানে ছুটে যান তিনি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইসিইউ ফাঁকা নাই, সব হাসপাতাল একই কথা বলছিল। পরে আরেক আত্মীয়ের মাধ্যমে মগবাজারের রাশমনো স্পেশালাইজড হাসপাতালে একটা আইসিইউ জোগাড় করতে পারি।’

রাজধানীর দুটি সরকারি এবং তিনটি বেসরকারি হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ছয়জন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, এখন অবস্থা এমন হয়েছে, সব সময় ১৫ থেকে ২০ জন রোগী আইসিইউর
অপেক্ষায় থাকছে। ডাক্তারদের এ ক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। কেউ সুস্থ হলে বা মারা গেলেই শুধু আইসিইউ শয্যা খালি হচ্ছে।

করোনায় আক্রান্ত জটিল রোগীদের জন্য হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত আইসিইউ এবং কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন থাকা জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্তদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জটিল প্রায় সব রোগীর আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি ভেন্টিলেশন দরকার হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার রাজধানীর ১০টি সরকারি ও ১৭টি বেসরকারি হাসপাতালে (করোনার জন্য নির্ধারিত বা করোনা ইউনিট রয়েছে) ৪৪৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৪৩৭টিতেই রোগী ভর্তি ছিল। গতকাল অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তির ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেখানে আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সংযুক্ত শয্যাকেও আইসিইউর হিসাবের সঙ্গে একত্রে দেখানো হয়েছে। তবে কতটি আইসিইউ ফাঁকা রয়েছে, সেটি আলাদা করে দেখানো হয়নি।

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ২৬টি আইসিইউর সব কটিই রোগীতে পূর্ণ। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউর কোনোটাই এক মুহূর্ত ফাঁকা থাকছে না, বরং একটি আইসিইউ ফাঁকা হওয়ার জন্য আরও অনেকজন অপেক্ষায় থাকছে।

গত বছরের জুন-আগস্ট মাসে দেশে করোনা প্রথম ঢেউয়ের চূড়ার (পিক) সময় সংক্রমণ ছিল তীব্র। এবার মার্চ মাস থেকে করোনার দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যু বেশি হচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এবার তীব্র উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেশি। কম সময়ে ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ায় অনেকেরই আইসিইউ লাগছে।

গত বুধবার রামপুরার বেটার লাইফ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ২৪টি আইসিইউ শয্যার সব কটিতেই রোগী ভর্তি ছিল। হাসপাতালের উপপরিচালক তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, একটি আইসিইউর শয্যা দিনে বহু মানুষ খোঁজ নিচ্ছেন। আইসিইউ শয্যা ফাঁকা হওয়া মাত্রই নতুন রোগী চলে আসছে।

করোনা সংক্রান্ত ফেসবুক গ্রুপগুলোতে আইসিইউ শয্যা জোগাড়ে সাহায্য চেয়ে পোস্ট দিচ্ছেন অনেকেই। করোনা সংক্রান্ত একাধিক ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনাকারী (এডমিন) বলছেন, মাঝে কয়েক মাস আইসিইউ শয্যার জন্য সাহায্য চেয়ে পোস্ট কম ছিল। এখন প্রতিদিন আইসিইউ নিয়ে পোস্ট আসছে। তাঁরা সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করেন, কিন্তু বর্তমানে একটি আইসিইউ জোগাড় করা রীতিমতো যুদ্ধজয়ের মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার খুরশীদ আলম গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে আগামী সপ্তাহে ২০০ শয্যার আইসিইউ চালু হবে। পাশাপাশি সেখানে ১ হাজার ১৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার থাকবে।

গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্লাজমা, চিকিৎসকের পরামর্শ পেতে সহায়তা করছে ‘সংযোগ: কানেকটিং পিপল’ নামের ফেসবুক গ্রুপটি। সংযোগের উদ্যোক্তাদের একজন আহমেদ জাবেদ জামাল বলেন, এখন আইসিইউর চাহিদা অকল্পনীয়ভাবে বেড়েছে।

গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু এক বছরেও দেশের অধিকাংশ জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা যায়নি। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার সব কটিতেই নতুন রোগী শনাক্ত বাড়ছে। অথচ বরিশাল বিভাগের শুধু বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, অন্য জেলার জটিল রোগীরাও এই হাসপাতালে আসছেন। কখনোই আইসিইউ ফাঁকা থাকছে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছর করোনা রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একেবারেই মনোযোগ দেয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। যথেষ্ট সময় পাওয়ার পরও পর্যাপ্ত আইসিইউর ব্যবস্থা করা যায়নি। এখন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।