আলোচনার কেন্দ্রে করোনার টিকা

টিকা কেনা ও সংগ্রহের পাশাপাশি টিকাদান ছিল স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় ঘটনা। স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি ছিল আলোচনায়।

অনিশ্চয়তা বোধের মধ্য দিয়ে ২০২১ সাল শেষ হচ্ছে। বছরের প্রথম দিকে টিকা দেওয়া শুরু হলে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বছর শেষে ভাইরাসটির নতুন ধরন অমিক্রনের উদ্ভব মানুষকে আবার উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। মহামারি নিয়ে এই অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্য দিয়ে নতুন বছর শুরু হতে যাচ্ছে।

শেষ হতে যাওয়া বছরটিতে স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর কেন্দ্রে ছিল করোনার টিকা। টিকা কেনা, টিকা সংগ্রহ, টিকাদান চলেছে বছরজুড়ে। বছরের একটা সময় করোনা সংক্রমণ ও করোনায় মৃত্যু বহুগুণ বেড়ে যায়। একটা পর্যায়ে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ডিসেম্বরের শেষে সামান্য হলেও সংক্রমণের কিছুটা ঊর্ধ্বগতি আবার লক্ষ করা যাচ্ছে।

বছরের মাঝামাঝি করোনা রোগীর চিকিৎসা, হাসপাতালের প্রস্তুতির ঘাটতির খবরে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনার চিত্র প্রকাশ পেয়েছিল। স্বাস্থ্য বিভাগের জবাবদিহির ঘাটতি আরও প্রকটভাবে প্রকাশ পায় যখন ১৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী দামে করোনার টিকা কেনা হচ্ছে, তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

টিকা চাই, টিকা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এর অর্থ সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা। তাঁদের সবাইকে দুই ডোজ করে টিকা দিতে ২৭ কোটি ডোজ দরকার। বছর শেষে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যার ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন, পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। গতকাল রোববারের এই হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।

লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি মানুষ এর মধ্যে পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। তবে টিকা পাওয়ার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে শুরু থেকে যে জটিলতা ছিল, বছর শেষেও তা রয়ে গেছে। ৬ কোটির মতো মানুষ এখনো নিবন্ধন করেননি। নিবন্ধন করেছেন এমন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এখনো টিকার প্রথম ডোজই পাননি।

বিপুলসংখ্যক মানুষ নিবন্ধন না করা, নিবন্ধন করেও টিকা না পাওয়া মূলত স্বাস্থ্য বিভাগের যথাযথ উদ্যোগের ঘাটতির কারণে হয়েছে। এর প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল টিকার উৎস খোঁজার ক্ষেত্রেও। শুরুতে টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শুধুই ভারতের ওপর নির্ভর করেছিল বাংলাদেশ। ২১ জানুয়ারি দেশে প্রথম ভারতের উপহারের টিকা আসে। ২৫ জানুয়ারি আসে কেনা টিকা। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে টিকা না পাওয়ায় একপর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি হোঁচট খায়। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় চীন। চীনের সিনোফার্মের টিকা এখন পর্যন্ত প্রধান উৎস হয়ে আছে। এরই মধ্যে ভারত, চীন, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে বাংলাদেশ উপহার হিসেবে টিকা পেয়েছে। পাশাপাশি কোভ্যাক্স থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে টিকা দেশে এসেছে। দেশে এখন পাঁচ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত টিকা দেওয়া হচ্ছে: অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, সিনোফার্ম, মডার্না ও সিনোভ্যাক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন উৎস থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার টিকা এসেছে। এর মধ্যে কেনা হয়েছে ৯ কোটি ২০ লাখ।

ইতিহাসে নাম লেখান রুনু

করোনার টিকা নিয়ে আগ্রহের পাশাপাশি মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ছিল। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তখন স্পষ্ট ছিল না। ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে কে প্রথম টিকা নেবেন, তা জানার আগ্রহ ছিল দেশজুড়ে।

দেশে প্রথম ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তাকে করোনার টিকা দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণের নতুন যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে করোনার গণটিকাদান শুরু হয়।

দেশ পেছাল বিজ্ঞানে

বাংলাদেশ এ পর্যন্ত করোনা টিকা ব্যবহারের সুবিধাই শুধু নিয়েছে। কিন্তু এই টিকা উদ্ভাবনের যে বৈশ্বিক জ্ঞান ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে, তাতে অবদান রাখতে পারেনি। একাধিক সুযোগ থাকলেও করোনা টিকার পরীক্ষা বাংলাদেশে হয়নি।

চীনের একটি টিকার পরীক্ষা বাংলাদেশে হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) প্রাথমিক অনুমোদনও দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এই পরীক্ষা করবে, তা-ও জানা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

অতিসম্প্রতি দেশি প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মার উদ্ভাবিত টিকা বঙ্গভ্যাক্সের প্রথম ধাপের পরীক্ষার প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার কথা জানা গেছে। তবে সেই পরীক্ষা কবে নাগাদ শুরু হবে বা আদৌ হবে কি না, তা এখনো কেউ নিশ্চিত নন।

বেড়েছিল সংক্রমণ, রেকর্ড মৃত্যু

শূন্যের কোঠায় না নামলেও বছরের শুরুতে দেশে সংক্রমণ কম ছিল। মার্চের মাঝামাঝি সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দৃশ্যমান হয়। তারপর থেকে সেই প্রবণতা জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত ছিল।

জুন-জুলাই মাস বাংলাদেশের জন্য অনেকটা দুঃসময়ের মতো ছিল। ১ জুন নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ছিল ৯ শতাংশের কিছু বেশি। মৃত্যু ছিল ৪১ জনের। ৩০ জুন শনাক্তর হার বেড়ে ২৫ শতাংশ হয় এবং ১১৫ জনের মৃত্যু হয়। এক মাস পর ৩১ জুলাই শনাক্তের হার বেড়ে হয় ৩০ শতাংশ এবং মৃত্যু হয় ২১৮ জনের। ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ৫ ও ১০ আগস্ট। ওই দুই দিনে ২৬৪ জন করে মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আগস্ট থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ২০ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে করোনায় মৃত্যুর কোনো সংখ্যা ছিল না।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বরাবরই বলে আসছেন, করোনা মোকাবিলায় সরকার সাফল্য দেখিয়েছে। দেশে করোনায় মৃত্যু তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

অবশ্য সংক্রমণের একটা পর্যায়ে দেশের কিছু অঞ্চলে রোগী এত বেশি ছিল যে হাসপাতালে শয্যাসংকটের কথা গণমাধ্যমে আসতে থাকে। অক্সিজেন-সংকটের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে স্বাস্থ্য বিভাগ।

১৭ ফাইল গায়েব

দুর্নীতির শিকড় স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক গভীরে। মহামারিকালেও স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি থেমে থাকেনি। এ বছর স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির খবরের মধ্যে হঠাৎ সামনে আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরির ঘটনা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আটকে রাখেন। একটি কক্ষে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে তাঁকে হেনস্তা-নির্যাতন করা হয়। তারপর ওই দিন রাতে তাঁর বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্টে মামলা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি নথি চুরির ঘটনাটি ব্যাপকভাবে জানাজানি হয় ২৮ অক্টোবর মন্ত্রণালয় রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর। জিডিতে ১৭টি নথির নম্বর ও বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল: শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি মেডিকেল কলেজের কেনাকাটাসংক্রান্ত একাধিক নথি, নিপোর্টের কেনাকাটা, ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত নথি। এ ছাড়া নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক প্রকল্পের নথি খোয়া যায়।

বছরের পর বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে চলেছে। তাই মন্ত্রণালয় থেকে কেনাকাটার নথি চুরি যাওয়ার ঘটনায় অনেকে মনে করেছিলেন যে যোগসাজশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। এ নিয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী চার কর্মচারীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু কেন নথি চুরি বা গায়েব হলো অথবা খোয়া গেল, তা মন্ত্রণালয় খোলাসা করে আজও বলেনি।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় সব ক্ষেত্রেই জবাবদিহির ঘাটতি আছে। অনেক কিছু লাগামছাড়া, নিয়ন্ত্রণহীন। স্বাস্থ্য খাত বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর ব্যতিক্রম নয়, কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বেশি। নতুন বছরে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা থেকে স্বাস্থ্য খাত বের হয়ে আসবে, এটা আশা করা যায় না।