উৎপাদনের নয়, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি গোপনীয়তার

ফাইল ছবি

রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি এখনো করেনি বাংলাদেশ। শুধু রাশিয়া টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিলে তা গোপন রাখা হবে, এমন একটি ‘গোপনীয়তার’ চুক্তিতে সই করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অব রাশিয়ান ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (আরডিআইএফ) মধ্যে গত বৃহস্পতিবার এ চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ তৃতীয় পক্ষের কাছে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করতে পারবে না। গোপন তথ্য হিসেবে ক্লিনিক্যাল ডেটা ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত এবং চুক্তির বিষয়বস্তুকে উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তিপত্রে সই করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বৃহস্পতিবার তাঁর বাসায় সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের জন্য চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যৌথ উৎপাদনের বিষয়ে চুক্তিটা হয়েছে।

গোপনীয়তার চুক্তির আওতায় রাশিয়া বাংলাদেশকে টিকা বা টিকা উৎপাদনের ফর্মুলা দেবে কি না, কবে দেবে—এসব বিষয় পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে গতকাল শনিবার মুঠোফোনে কল করা, খুদে বার্তা পাঠানো ও ই-মেইল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। গত রাতে স্বাস্থ্যসেবাসচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার সময় রাশিয়ার টিকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা পাওয়ার তিনটি বিকল্প রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এক. সরাসরি বাণিজ্যিকভাবে টিকার ডোজ কেনা। দুই. বাল্কে (বিপুল পরিমাণ) আমদানি করে দেশে ডোজ হিসেবে বোতলজাত করা। তিন. দেশেই রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে উৎপাদন করা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড-১৯–এর টিকাপ্রাপ্তির উৎস ও সংগ্রহসংক্রান্ত কোর কমিটির মতামতসহ সুপারিশ পাওয়ার পরই কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি হবে। আগামীকাল সোমবার এ কমিটির মতামত দেওয়ার কথা। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যেটা হয়েছে, সেটা শুধু একটি কাঠামো। রাশিয়া টিকা দেবে কি দেবে না, এমন কোনো চুক্তি নয়।

ভারতের কাছ থেকে করোনার টিকা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়ায় গত সপ্তাহে সরকার রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকা পাওয়ার বিষয়ে উদ্যোগী হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দেশের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে মতামতসহ সুপারিশ দিতে ১৯ এপ্রিল আট সদস্যের ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির উৎস ও সংগ্রহসংক্রান্ত কোর কমিটি’ গঠন করে। কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত বুধবার। এ বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসে দেশে টিকার যে মজুত আছে, তা আগামী ১৫ মের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

বৈঠকে কমিটির সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি ও চীনের চায়না সিনোফার্ম ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনের টিকা আমদানির প্রস্তুতি হিসেবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে ইতিবাচক মত দেন। এর আগে রাশিয়ার টিকা আমদানি ও উৎপাদনে সক্ষম প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্যাদি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে দেওয়া হয়।

রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা পেতে আগেই তৎপরতা চলছিল। বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বৈঠক করেন। এ নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি চালাচালি করছে। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ১২ এপ্রিল এক চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে জানিয়েছিলেন, রাশিয়া স্পুতনিক-ভি টিকা বাংলাদেশে পাঠানো, এ দেশে উৎপাদন ও ব্যবহারের বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে চায়। এগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশে টিকার চাহিদা কত এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে সক্ষম।

আমরা এ মহামারির সময়ে সংবেদনশীল পরিস্থিতির মধ্যে আছি। বিশেষ করে ভারত থেকে টিকা আসাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় আমরা রাশিয়াসহ বিভিন্ন উৎসের সন্ধানে আছি। এমন সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে চলমান দর–কষাকষি নিয়ে আরেকটু সাবধানে, সংযতভাবে মন্তব্য করাটাই সমীচীন।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানের নাম পাঠান। তাঁদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশে টিকা উৎপাদন করতে পারবে ওষুধ কোম্পানি ইনসেপ্‌টা লিমিটেড ফার্মাসিউটিক্যালস, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস ও হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এরা প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে স্পুতনিক-ভি টিকা এক থেকে দুই মাসের মধ্যে উৎপাদনে যেতে পারবে। এ ছাড়া বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, রেনাটা লিমিটেড ও এক্‌মি ফার্মাসিউটিক্যালস টিকা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপনে সক্ষম। অবকাঠামো প্রস্তুত করতে তাদের আনুমানিক এক বছর সময় লাগবে।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ২০ এপ্রিল স্বাস্থ্যসেবাসচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে একটি জরুরি চিঠি দেন। তিনি লেখেন, রাশিয়া বাংলাদেশকে আগামী মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৪০ লাখ, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি এবং ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৩ কোটি ৬০ লাখ ডোজ টিকা দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। টিকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া ও চুক্তি করতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

এরপর গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন রাশিয়ার সঙ্গে টিকার যৌথ উৎপাদনের চুক্তির বিষয়টি জানান। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা পাওয়ার তিনটি বিকল্প রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এক. সরাসরি বাণিজ্যিকভাবে টিকার ডোজ কেনা। দুই. বাল্কে (বিপুল পরিমাণ) আমদানি করে দেশে ডোজ হিসেবে বোতলজাত করা। তিন. দেশেই রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে উৎপাদন করা। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, যে বিকল্পই বাংলাদেশ বেছে নিক, আগে গোপনীয়তার চুক্তি করতে হবে। সেটাই করা হয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশের আগেই বাংলাদেশের মানুষ করোনার টিকা পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু মাঝপথে এসে গণটিকাদান কর্মসূচি অনিশ্চয়তায় পড়েছে ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে। এখন অন্য কোনো দেশ থেকে টিকা আসে কি না, তার দিকে তাকিয়ে আছে দেশের মানুষ।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ মহামারির সময়ে সংবেদনশীল পরিস্থিতির মধ্যে আছি। বিশেষ করে ভারত থেকে টিকা আসাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় আমরা রাশিয়াসহ বিভিন্ন উৎসের সন্ধানে আছি। এমন সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে চলমান দর–কষাকষি নিয়ে আরেকটু সাবধানে, সংযতভাবে মন্তব্য করাটাই সমীচীন।’