একজন রোগীর পেছনে লাখ টাকার বেশি খরচ

করোনা চিকিৎসা নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা। এই গবেষণা নীতিনির্ধারকদের কাজে লাগবে

সরকারি করোনা হাসপাতালে সাধারণ শয্যার একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এর ৬০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন–ভাতা ও থাকা–খাওয়ায়। ওষুধ ও পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ব্যয় হওয়া ১৮ শতাংশের বড় অংশ বহন করে রোগী।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় করোনা চিকিৎসার খরচের এই হিসাব বেরিয়ে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগও এই গবেষণায় যুক্ত ছিল। গবেষকেরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা ব্যয় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। মহামারি মোকাবিলার জাতীয় পরিকল্পনা হালনাগাদ করতে এবং সম্পদ বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে এই গবেষণা ফলাফল সরকারের কাজে লাগবে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন।

গবেষকেরা ঢাকা শহরের প্রধান চারটি সরকারি করোনা হাসপাতাল এবং দুটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যার ৩১ হাজার ১৪৭ জন এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ২ হাজার ৯১৮ জন রোগীর ব্যয় বিশ্লেষণ করেছেন। গত ডিসেম্বর মাসে এই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আংশিক প্রকাশ করা হয়েছিল। একটি আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকীতে গবেষণা ফলাফল প্রবন্ধ আকারে প্রকাশের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে বলে গবেষকদের পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় বিনা মূল্যে। করোনার ক্ষেত্রেও সরকার বলছে, চিকিৎসা তারা বিনা মূল্যেই দিচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের আত্মীয় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর গত ১২ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর ওই আত্মীয় ২৩ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।

গতকাল শুক্রবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, আত্মীয়ের জন্য নির্দিষ্ট একটি ওষুধ প্রতিদিন কিনতে হতো। এ ছাড়া কিছু পরীক্ষাও করা হতো হাসপাতালের বাইরে থেকে। এসব করতে ১১ দিনে নিজেদের পকেট থেকে খরচ হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকা। গবেষণাতেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রধান গবেষক এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা পরিচালক মো. নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোভিড–১৯ রোগী ব্যবস্থাপনায় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব বের করা। বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালে ব্যয়ের পার্থক্য তুলনা করাও গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

কোন খাতে কত ব্যয়

গবেষকেরা বলছেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চারটি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য খরচ হয়েছিল ৪৬৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। ব্যয়ের মধ্যে ছিল যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক–নার্সসহ কর্মকর্তা–কর্মচারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর বেতন–ভাতা, তাঁদের হোটেল ভাড়া, যাতায়াত ও খাওয়ার খরচ, ওষুধ, রোগনির্ণয় পরীক্ষা, অক্সিজেন সরবরাহ, পিপিই, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, রোগীর খাবার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, লন্ড্রি, ফোন, ইন্টারনেট ও পরিচ্ছন্নতার কাজে।

এর মধ্যে ৬০ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে চিকিৎসক–নার্সসহ কর্মকর্তা–কর্মচারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর বেতন–ভাতা, তাঁদের হোটেল ভাড়া, যাতায়াত ও খাওয়া বাবদ। অর্থাৎ প্রায় ২৮০ কোটি টাকা খরচ হয় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পেছনে।

অন্যদিকে দুটি বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় ৫৬৩ জন এবং ২১৮ জন আইসিইউ রোগীর আত্মীয়রা খরচ করেছিলেন ২৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর ৫ দশমিক ৭ শতাংশ চিকিৎসক–নার্সসহ কর্মকর্তা–কর্মচারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য ব্যয় করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও রোগনির্ণয় খাতে খরচ হয় যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ ও ২ দশমিক ৪ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালে এই হার যথাক্রমে ৩০ ও ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

সরকারি বেসরকারিতে পার্থক্য

গবেষকেরা দেখেছেন, বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর গড় অবস্থানকাল সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কম। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় একজন রোগী গড়ে চিকিৎসা নেন ১০ দিন। বেসরকারি হাসপাতালে ৬ দশমিক ৫২ দিন। একইভাবে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে একজন রোগী গড়ে চিকিৎসা নেন ৮ দিন, বেসরকারি হাসপাতালে গড় অবস্থানকাল ৭ দশমিক ৩৯ দিন। তবে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী ভর্তি করানোর প্রবণতা বেশি।

তবে বেসরকারি হাসপাতালে দৈনিক গড় খরচও বেশি। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউতে দৈনিক গড় খরচ যথাক্রমে ১২ হাজার ৮১১ টাকা এবং ৫১ হাজার ৬ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে দুই ধরনের শয্যায় দৈনিক গড় খরচ যথাক্রমে ৩৭ হাজার ১২৮ টাকা এবং ৬৮ হাজার ৮৮৫ টাকা।

সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় বেশি ব্যয় হচ্ছে। গবেষণাতেও তা উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনা চিকিৎসার প্রটোকল বা চিকিৎসাবিধি সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা কেউ দেখছেন না। সুতরাং বাড়তি ওষুধ বা পরীক্ষা–নিরীক্ষা বেশি হচ্ছে কি না, তা নজরদারির মধ্যে নেই। তবে হাসপাতালে রোগীর অবস্থানের তারতম্য কেন হবে, তা খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে।

অন্য দেশে খরচ কত

চীনের ৭০ জন রোগীর খরচ নিয়ে গবেষণার তথ্য আছে বাংলাদেশের এই গবেষণা প্রবন্ধে। তাতে দেখা যাচ্ছে, চীনে গড়ে একজন রোগীর জন্য ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৮২৭ মার্কিন ডলার বা ৫ লাখ ৮০ হাজার ২৯৫ টাকা। এর মধ্যে ওষুধের জন্য খরচ হয় ৪৫ শতাংশ, আর পরীক্ষা–নিরীক্ষার খরচ ১৯ শতাংশ। তবে দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁদের জন্য খরচ হয়েছে বেশি, প্রায় ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় চিকিৎসা ব্যয় বিষয়ে আমাদের হাতে কোনো তথ্য ছিল না। এই গবেষণা নতুন তথ্য তুলে দিয়েছে। এই গবেষণার তথ্য মহামারি মোকাবিলায় সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকেরা কাজে লাগাতে পারবেন।’