এক সপ্তাহে মৃত্যু ও রোগী বেড়েছে প্রায় ৫০%

ফাইল ছবি
ছবি: প্রথম আলো

দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বোঝার জন্য দুটি তথ্যই যথেষ্ট। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগী বেড়েছে ৪৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।×আর করোনার সংক্রমণে মৃত্যু ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে গতকাল শনিবার।

এমন পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার রাতে সরকার দেশজুড়ে কঠোর লকডাউনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারির কথা থাকলেও তা হয়নি।

সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আগামীকাল সোমবার থেকে সীমিত পরিসরে ‘লকডাউন’ শুরু হবে। তখন থেকেই সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। এই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আর বৃহস্পতিবার থেকে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হবে।

লকডাউন নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সভা হয়। সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, অর্থবছরের শেষ সময় হওয়ায় সরকারি সিদ্ধান্তে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিল্পকলকারখানা লকডাউনের আওতার বাইরে থাকতে পারে। সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবাও চালু থাকতে পারে। জরুরি সেবা ছাড়া আর সবকিছু সর্বাত্মক লকডাউন শুরুর পর বন্ধ হয়ে যাবে।

গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের চলাচল লকডাউনের আওতার বাইরে থাকবে। লকডাউনের বিস্তারিত আজ রোববার প্রজ্ঞাপন দিয়ে স্পষ্ট করা হবে।

রাজধানী ঢাকার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ২২ জুন থেকে ঢাকার আশপাশের চার জেলাসহ মোট সাত জেলায় লকডাউন চলছে। ৩০ জুন পর্যন্ত মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জে লকডাউন দিয়ে কার্যত রাজধানী ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা ছিল। তবে সে চেষ্টা কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই দেশজুড়ে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এদিকে দেশে করোনা সংক্রমণের ৬৮তম সপ্তাহ (২০-২৬ জুন) গতকাল শেষ হয়েছে। এই সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। করোনায় সংক্রমিত হয়ে গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন প্রায় ৮৪ জন। এর আগের সপ্তাহে (১৩-১৯ জুন) প্রতিদিন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৩ হাজার ৩৬৩ জন করে। আর প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হয়েছিল ৫৬ জনের। তারও আগের সপ্তাহে (৬-১২ জুন) প্রতিদিন গড়ে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল ২ হাজার ১৬৭ জন। আর মৃত্যু হয়েছিল গড়ে ৩৮ জনের।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক দূরে। লকডাউন কার্যকর করার পর সংক্রমণের গতি ধীর হতেও সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগে। সে হিসাবে আরও বেশ কিছুদিন সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সে সঙ্গে মৃত্যুও বাড়তে পারে। লকডাউনের পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো, শনাক্ত হওয়া রোগীদের আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন করা) রাখা, তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনের (সঙ্গনিরোধ) ব্যবস্থা এবং সবার স্বাস্থ্যবিধি বিশেষত মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে লকডাউনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর আবারও সংক্রমণ বেড়ে যাবে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল সরকার। এর প্রভাবে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছিল। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়। ঈদের পর সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে দ্রুত সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। এখন দেশের প্রায় সব জেলাতেই সংক্রমণ বাড়ছে।

সংক্রমণের শুরু থেকে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে এবং চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের জেলাগুলোতে সংক্রমণ বেশি ছিল। বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল বেশি। এবার বিশেষত ঈদুল ফিতরের পর থেকে সংক্রমণ বেশি বাড়ছে উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। গ্রামেও সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসুবিধা অপ্রতুল হওয়ায় এবার মৃত্যু বেশি হওয়ার শঙ্কা আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সংক্রমিত আরও ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যু দাঁড়াল ১৪ হাজার ৫৩ জনে। মাঝে সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও চলতি মাসের শুরু থেকে আবার মৃত্যু বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ১ হাজার মৃত্যু ছাড়াতে সময় লেগেছে ১৫ দিন। বিশ্বে নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকে প্রায় সব দেশের হালনাগাদ তথ্য রাখছে ওয়ার্ল্ডোমিটারস নামের একটি ওয়েবসাইট। তাদের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৮তম।

গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ জন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৮ লাখ ৮৩ হাজার ১৩৮ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১৯ হাজার ২৬২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। সেখানে কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় সে হার অনেক বেশি। যেমন এখন দেশের যেসব জেলায় সংক্রমণ অনেক বেশি তার একটি যশোর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় এই জেলায় রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ, মানুষকে ঘরে রাখা—এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে সংক্রমণ দমন করা যায়। কিন্তু শুধু এটাই যথেষ্ট নয়। এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে, সংক্রমণের উৎস কমাতে হবে। এ জন্য সার্ভিল্যান্স বা রোগ নজরদারি এবং রোগী ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। স্বাস্থ্য বিভাগকে রোগী ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা (আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারেন্টিন) বাড়াতে হবে।