বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের বাসিন্দা কুমুদ মণ্ডল (৭৮) করোনায় আক্রান্ত হয়ে খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তির কিছুক্ষণ পরই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁর জন্য আইসিইউর দরকার পড়ে। তবে শয্যা খালি না থাকায় তাঁকে আইসিইউতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ভর্তির এক দিন পর ৮ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়।
কুমুদ মণ্ডলের মতো অনেক রোগীই একেবারে শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসছেন বলে জানান ওই হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের তত্ত্বাবধায়ক দিলীপ কুমার কুণ্ডু। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চিকিৎসা চলার সময় খুব দ্রুত এসব রোগীর অবস্থার অবনতি হয়। এ সময় আইসিইউতে শয্যা খালি না থাকায় অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই সে সময় কিছু করার থাকছে না। এতে রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আইসিইউ ও অক্সিজেন–সুবিধা বাড়ানো গেলে মৃত্যু আরও কমানো সম্ভব হতো বলে মনে করেন তিনি।
খুলনা বিভাগে গত ১২ জুন থেকে আজ ১২ জুলাই পর্যন্ত করোনায় ৯৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৩৪ হাজারের বেশি নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। বর্তমানে শয্যাসংখ্যার অতিরিক্ত রোগী সামাল দিতে অধিকাংশ হাসপাতালই হিমশিম খাচ্ছে। বিভাগের সব হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ৬৪টি আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই বলে জানা গেছে। এদিকে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল ও মাগুরা সদর হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। বাগেরহাটে আইসিইউ থাকলেও সেটি চালুর জন্য জনবল ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নেই।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগের ১০ জেলায় করোনা রোগীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ হাজার ৫৮৭টি সাধারণ শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে এইচডিইউ শয্যা আছে ৬৫টি। আর আইসিইউ শয্যা আছে ৬৪টি। বিভাগের হাসপাতালগুলোয় আজ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০৭ জন করোনা রোগী ভর্তি আছেন। এই হিসাবের বাইরেও করোনা উপসর্গ নিয়ে বিপুলসংখ্যক রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
করোনা রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে প্রতিদিন সুস্থ হওয়া রোগীর চেয়ে শনাক্তের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসাধীন রোগী বাড়তে থাকায় হাসপাতালে শয্যাসংকট দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ার হাসপাতালগুলোয় চাপ অনেক বেশি। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সূচকেও এই তিন জেলা বিভাগের শীর্ষে আছে।
খুলনার ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, আইসিইউ প্রয়োজন, এমন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আইসিইউর জন্য নানা তদবির আসছে। কিন্তু এখানে কিছুই করার থাকছে না। এর বাইরেও রোগীদের জন্য প্রচুর অক্সিজেন লাগছে। হাসপাতালের নতুন অক্সিজেন প্ল্যান্টটিও চালু করা যাচ্ছে না। সিলিন্ডারের ওপর ভরসা বাড়ছে। তবে সিলিন্ডার অক্সিজেনের ওপর ভর করে করোনার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন।
খুলনার সরকারি দুটি হাসপাতালের আইসিইউ কখনোই খালি থাকছে না। এখন অবস্থা এমন হয়েছে, সব সময় ৩০–৪০ জন রোগী আইসিইউর জন্য অপেক্ষায় থাকছেন।দিলীপ কুমার কুণ্ডু, তত্ত্বাবধায়ক, আইসিইউ ইউনিট, খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল
খুলনার করোনা হাসপাতালগুলো ঘুরে গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, রোগীর চাপ সামাল দিতে চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতালের কর্মীদের বেগ পেতে হচ্ছে। ভর্তির জন্য রোগী আর স্বজনেরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন। ঘুরছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। শয্যা না পেয়ে অনেকের ঠাঁই হচ্ছে মেঝেতে। এসব হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫–২০ জন করে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন। এদিকে এক মাস ধরে বিভাগে শনাক্ত যেমন বাড়ছে, তেমনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১২ মে থেকে ১২ জুন পর্যন্ত এক মাসে বিভাগের সব হাসপাতাল মিলিয়ে এক হাজার দুজন করোনা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরপর গত ১২ জুন থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত এক মাসে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭১১ জন। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রোগীর সংখ্যা সাড়ে চারগুণেরও বেশি বেড়েছে।
দিলীপ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘আগের চেয়ে রোগীরা এখন বেশি হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। খুলনার সরকারি দুটি হাসপাতালের আইসিইউ কখনোই খালি থাকছে না। এখন অবস্থা এমন হয়েছে, সব সময় ৩০–৪০ জন রোগী আইসিইউর জন্য অপেক্ষায় থাকছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করণীয় থাকছে না। কেউ সুস্থ হলে বা মারা গেলেই তবে আইসিইউ শয্যা খালি হচ্ছে।’
এখন পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় মোট ৭৩ হাজার ১৯২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ হাজার ১০৬ জন সুস্থ হয়েছেন। মারা গেছেন ১ হাজার ৬৪১ জন। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯ হাজার ৭৮৪ জন। অর্থাৎ প্রায় ১৩ শতাংশের কিছু বেশি রোগী হাসপাতালে থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। অন্যরা বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন।