কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতায় এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে

করোনার টিকা
ছবি: এএফপি

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন ৫৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৯টি করে করোনার টিকা দেওয়ার কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ পরিকল্পনা নিয়ে ৪৮৬টি টিকাকেন্দ্র নির্ধারিত করে প্রচার-প্রচারও করা হয়। কিন্তু আজ শনিবার সকালে এসে একেকটি ওয়ার্ডে ৩টি করে কেন্দ্র কমানো হয়। এতে পূর্বনির্ধারিত অনেক কেন্দ্রে টিকা দিতে গিয়ে অনেকে করপোরেশনের কর্মীদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, অনেকে আবার ছুটেছেন এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে।

ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাঁদের যে সংখ্যক জনবল দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। জনবল পর্যাপ্ত না পাওয়ার সিদ্ধান্ত তারা গতকাল (শুক্রবার) রাতে জানতে পেরেছেন। এই সিদ্ধান্ত জানার পর প্রতিটি ওয়ার্ডে ৯টি টিকাকেন্দ্রের বদলে ৬টি করা হয়। আর কোন তিনটি কেন্দ্র বাদ দেওয়া হবে, এই দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের। যে কারণে শেষ পর্যন্ত কোন কেন্দ্রগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেটা আজ সকাল পর্যন্তও জানতেন না সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

ডিএনসিসির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বনির্ধারিত ৯টি টিকাকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৪টি কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হচ্ছে। তালিকার বাইরে দেওয়া হচ্ছে মোহাম্মদপুরের টাউন হল এলাকায় ত্রিকোণ পার্কের ভেতরে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতির অস্থায়ী কার্যালয়ে এবং শের-শাহ সুরী সড়কের বায়তুল ফালাহ মাদ্রাসায়। আর পূর্ব নির্ধারিত কেন্দ্রের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম রোড কলোনি, মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থান মাঠ, শাহ্জালাল হাউজিং ও স্বপ্নধারা হাউজিং এলাকা বাদ গেছে।

সকাল ৯টায় মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের টিকাদান কর্মীদের না দেখতে পেয়ে টিকা দিতে যাওয়া অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন। অনেকে আবার পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানার চেষ্টা করছেন, অন্য কোন জায়গায় টিকা দেওয়া হচ্ছে?

সেখানে কেন্দ্রে দিতে গিয়েছিলেন মোহাম্মদপুরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়কের বাসিন্দা গৃহিণী মমতাজ বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছিল এই কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে। বাসার কাছে হওয়ায় এই কেন্দ্রেই এসেছিলাম। কিন্তু এসে জানলাম এখানে দেওয়া হবে না। করপোরেশনের কর্মীরা আসবে ভেবে তিনি সেখানে সাড়ে ৮টা থেকে অপেক্ষা করেছেন বলেও জানান।

ডিএনসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে পূর্বনির্ধারিত কেন্দ্রের মধ্যে আজিজ মহল্লার মার্কেট ক্যাম্প, স্লাম জহুরি মহল্লা ও ৩২ নম্বর কোয়াটার রিলিফ ক্যাম্প বাদ গেছে। সকাল থেকে ওই কেন্দ্রগুলোতেই টিকা দিতে গিয়ে অনেকে ফিরে গেছেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টার টিকাকেন্দ্রে সোয়া ১১টার দিকে নারীদের লাইনে অনেক পেছনের দিকে ছিলেন আসমা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকাল ৮টা থেকে কৃষিমার্কেট এলাকার আজিজ মহল্লা কেন্দ্রে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে তিনিও অপেক্ষায় ছিলেন। এর এক ঘণ্টা পরে করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জানান, টিকা দেওয়া হচ্ছে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে। পরে ওই জায়গা থেকে এসে আবার এখানে নতুন করে লাইনে দাঁড়ান।

পূর্ব তালিকা অনুযায়ী ডিএনসিসির ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়েও টিকা দেওয়ার কথা ছিল। সকালে সেখানে টিকা নিতে গেলে কেন্দ্র পরিবর্তনের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন বিউটি পারলারের কর্মী মুন্নী চিসিম। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন টিকা দেওয়া হবে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের গুদারাঘাট কাঁচাবাজারেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুদারাঘাট কেন্দ্রটি বাসার কাছেই। কিন্তু ওই কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে সেটা জানা ছিল না। আর কাউন্সিলর কার্যালয়ে টিকা দেওয়া হলে, আমাকে আর আবার ফিরে আসতে হতো না।’

পূর্বনির্ধারিত কেন্দ্র বাদ দেওয়ার বিষয়ে ডিএনসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ৬৮০ জন নার্স চেয়েছিলাম। দুটি হাসপাতাল থেকে ৬০ জন করে ১২০ জন নার্স দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে সেটা সম্ভব হয়নি। পর্যাপ্ত জনবল না থাকার কারণেই কেন্দ্রের সংখ্যা কমাতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আজকে লাইনে যতক্ষণ মানুষ থাকবে, ততক্ষণে টিকাদান চালিয়ে যাওয়া হবে। এ ছাড়া এই কার্যক্রম প্রয়োজনে আগামীকালও করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে করোনার টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার শেষ সুযোগের দিনে কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রের সামনেই নারী ও পুরুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।

সকালে মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটি সেন্টার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কমিউনিটি সেন্টারের প্রবেশের দুটি পৃথক ফটক দিয়ে নারী ও পুরুষের দুটি লাইন করা হয়েছে। মানুষের ভিড়ে দুটি সারিই মূল সড়ক পর্যন্ত চলে গেছে।

টিকা দিতে আসা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবেদনের পর মুঠোফোনে খুদে বার্তা না আসার কারণে, জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায়, জন্মনিবন্ধন দিয়ে আবেদন করতে না পারায় এত দিন টিকা দিতে পারেননি। অনেকে এলাকায় গিয়ে আবেদন করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর জেনেছেন, টিকা শেষ। ছুটি শেষ করে ঢাকায় ফিরে আর গ্রামে যাওয়া না হওয়ায় টিকা দিতে পারেননি বলেও কেউ কেউ জানান।

ভোলার লালমোহনের বাসিন্দা কালা মিয়া সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বাড়িতে নিবন্ধন করেছিলাম। লাইনে দাঁড়িয়ে জানতে পারি টিকা শেষ। পরে ঢাকা চলে আসি। এত দিনে গ্রামের বাড়িতে যেতে না পারার কারণে আর টিকা নেওয়া হয়নি।

মালেকা বানু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাবেয়া আক্তার। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তিনি বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন দিয়ে একাধিকবার নিবন্ধনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু হয়নি। করপোরেশনের প্রচারণা থেকে জানতে পারলাম মোবাইল নম্বর থাকলেই টিকা নেওয়া যাবে। তাই আজ টিকা নিতে এলাম।’