জরুরি কেনাকাটায় সমন্বয়হীনতা

কেন্দ্রীয় ঔষধাগার বলছে, মজুত সামগ্রী দিয়ে ১৫-২০ দিন চলবে। পরিকল্পনার অভাবে এ অবস্থা। অধিদপ্তর বলছে, ঘাটতি নেই।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও রোগীর চিকিৎসায় জরুরি সামগ্রী কেনাকাটায় সমন্বয় নেই। এই সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। একটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, অন্যটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)।

চিকিৎসাসামগ্রীর মজুত নিয়ে এই দুই প্রতিষ্ঠান দুই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগার বলছে, কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাদের কাছে যে মজুত আছে, তা দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু তারা বারবার বলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ক্রয় পরিকল্পনা পায়নি।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষাসামগ্রীর যে মজুত আছে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তিন মাসের পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রয় করলে কোনো সমস্যা হবে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির এই সময়ে সমন্বয় খুবই জরুরি। দুটি প্রতিষ্ঠানকে এক সুরে কথা বলতে হবে। অন্যকে দোষারোপ করার সময় এটা নয়। আসলে ঘাটতি আছে কি না, পরবর্তী প্রস্তুতি কী, তা সবাই মিলে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে বিভিন্ন হাসপাতালে নানা ধরনের ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। অথচ বিমানবন্দরে ১০ মাস ধরে পড়ে ছিল ১০২ কোটি টাকার জীবন রক্ষাকারী নানা সরঞ্জাম ও সামগ্রী। দেখা গেছে, শুধু উদ্যোগের অভাবে এসব খালাস করা হয়নি। যদিও সামগ্রীগুলো কেনা হয়েছিল জরুরি প্রয়োজন মেটাতে। ১৩ এপ্রিল এ নিয়ে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশের পর মাত্র সাত দিনেই জটিলতা কেটে গেছে। খালাস শুরু হয়েছে বিমানবন্দরে পড়ে থাকা পণ্যের।

এবার দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের মধ্যে সমন্বয় নেই। যেমন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে ১ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে দুই কার্য দিবসের মধ্যে ছয় মাসের ক্রয় পরিকল্পনা পাঠাতে বলা হয়। তারপরও তাদের কাছ থেকে কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানো হয়নি।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগার বলছে, গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগে থেকেই ভবিষ্যৎ ক্রয় পরিকল্পনা করার দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সিএমএসডি কোনো উৎস থেকেই এখন পর্যন্ত কোনো ক্রয় পরিকল্পনা পায়নি। এমনকি মহামারির আকস্মিক নাজুক অবস্থাতেও কোনো জরুরি ক্রয় পরিকল্পনা পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেমডিসিভির ইনজেকশনের স্বল্পতা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসাসামগ্রী বা সরঞ্জামের সংকট নেই। তবে এই ইনজেকশনের ব্যবহার নিয়েও চিকিৎসকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তারপরও আমরা অতি অল্প সময়ে এই ইনজেকশন সরবরাহ নিশ্চিত করব।’

ছয় মাসের ক্রয় পরিকল্পনা সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘ছয় মাসের ক্রয় পরিকল্পনায় টাকার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এতে টাকা ছাড় করাতে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। তাই আমরা তিন মাসের পরিকল্পনা দিয়েছি।’

সিএমএসডির চিঠিতে ঘাটতির কথা

কেন্দ্রীয় ঔষধাগার চিকিৎসা উপকরণ ও সরঞ্জামের মজুত পরিস্থিতি জানিয়ে ৮ এপ্রিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে একটি চিঠি দেয়। এই চিঠিতেই মজুত সামগ্রী দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন চলা সম্ভব হবে বলে জানানো হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, সরকারি ক্রয়বিধি পিপিএ ২০০৬ ও ২০০৮-এর সকল বিধিবিধান পালন করে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ক্রয়কাজ সম্পাদন করে পণ্য সরবরাহ পেতে ন্যূনতম তিন থেকে সাড়ে তিন মাস সময় লাগে। এমনকি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কেনাকাটা করলেও সরবরাহ পেতে এক থেকে দেড় মাস লাগে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, কোভিড-১৯-এর বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পণ্যের উৎস দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও যাতায়াতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।

সিএমএসডি আরও বলেছে, করোনা পরিস্থিতির অবনতিতে হাসপাতালের সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা বেড়ে গেছে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য সিএমএসডির কাছে বর্তমানে ১৮ ভায়াল ইনজেকশন (রেমডিসিভির), ১৩৯টি ভেন্টিলেটর, ৩১৩টি ৫/৩ ফাংশনাল ইলেকট্রনিক আইসিইউ বেড, ২৫২টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা, ২ হাজার ৫৮টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, ৭ হাজার ২২০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ২৫টি পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন মজুত আছে। আইসিইউ বেড সরবরাহের সময় এবং বিভিন্ন কোভিড কেন্দ্রে আইসিইউ স্থাপনের জন্য আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটরের সঙ্গে পেশেন্ট মনিটর, এবিজি মেশিন, সাকশন মেশিনের চাহিদা থাকে। কিন্তু সিএমএসডির কাছে শুধু ৫০টি পেশেন্ট মনিটর, একটি এবিজি মেশিন, একটি সাকশন মেশিন রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেরই নগণ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৮ এপ্রিলের চিঠির হিসাব অনুযায়ী ল্যাবে মাত্র ৩ লাখ ৩০ হাজারের মতো করোনা পরীক্ষার আরটি-পিসিআর কিট মজুত রয়েছে, যা দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিন পরীক্ষা চালানো যাবে।

কিটের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কিটের কোনো সংকট নেই, সংকট হবে না। সময়মতো কিট সংগ্রহের ব্যবস্থাও আছে।’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তাগিদের পর তাড়াহুড়া

সিএমএসডির চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। চিঠিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ১ এপ্রিল দেওয়া চিঠির বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, তাদের অতি জরুরি ভিত্তিতে সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জামের আগামী ছয় মাসের চাহিদা পাঠাতে বলা হয়েও তা পাওয়া যায়নি।

সিএমএসডির চাহিদা চেয়ে দেওয়া চিঠির পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আরেকটি চিঠিতে চাহিদা পাঠানোর তাগিদ দেয়। সূত্র জানিয়েছে, চিঠি পাওয়ার পর ওই দিনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাড়াহুড়ো করে একটি প্রস্তাব পাঠায়। তবে সেখানে মালামাল কেনার সম্ভাব্য ব্যয় এবং অর্থের উৎস উল্লেখ করা হয়নি।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই চিঠি ই-মেইলে পাঠিয়েছে ১৫ এপ্রিল বিকেল তিনটায়। কিন্তু তারিখ দিয়েছে ৫ এপ্রিলের। তাদের অপূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্যও নয়। ফলে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠাতে সিএমএসডির পক্ষ থেকে আবারও তাদের বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ক্রয় প্রস্তাব পাঠাতে দেরি করায় আমরা সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জামের দিক থেকে বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারি। বিশেষ করে কিটের। তাদের বারবার চিঠি দেওয়ার পরও তারা ক্রয় প্রস্তাব পাঠায়নি। এমনকি তারা দুই দিন আগে কিছু মালামালের পরিমাণ উল্লেখ করে একটি চিঠি দিয়েছে, যেটাকে প্রস্তাব বলা যায় না। তবে আমরা অন্যত্র থেকে কিট সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।’

‘হস্তক্ষেপ করা উচিত’

করোনার শুরুর দিকে গত বছর স্বাস্থ্য খাতে সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগে প্রস্তুতির বেশ সময় পেয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে চিঠি চালাচালিতে স্পষ্ট যে এ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। এর মাশুল দিতে হয় করোনার রোগীদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্যের দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেনাকাটার মতো বিষয়ে সমন্বয়হীনতা থাকলে তা হবে দুঃখজনক। সমন্বয়হীনতা থাকলে এখনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করা উচিত।’