জ্বর–কাশি হলে ওষুধ কিনে খেতেন তাঁরা, এবার পেলেন টিকা

কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় ভাসমান মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া শুরু করেছে সরকার। ঢাকা, ৬ ফেব্রুয়ারিছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে শুরু হয়েছে ভাসমান জনগোষ্ঠীকে করোনার টিকা প্রদান। আজ রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় কমলাপুর ও আশপাশের এলাকার ভাসমান ব্যক্তিদের জনসন অ্যান্ড জনসনের করোনার টিকা দেওয়া হয়।

আজ সেখানে প্রথম টিকা নেন ১৮ বছর বয়সী মো. রবিন। ছয় বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় ডান পা হারিয়েছেন তিনি। তখন থেকেই বাঁশে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। থাকেন স্টেশনে, চেয়েচিন্তে খান। রবিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা নিয়ে অনেক ভালো লাগছে। আমাদের দেহার কেউ নাই। আমি এর আগে কহনো কোনো টিকা নেয় নাই। হাতে কোনো ব্যথা লাগে নাই।’

৪০ বছর বয়সী শান্তা খাতুন কোন সালে কমলাপুর স্টেশনে এসেছেন বলতে পারলেন না। তবে জানালেন, এরশাদের আমলে তাঁর বয়স ১০ বছর ছিল। সে সময় থেকে তিনি এ স্টেশনেই থাকছেন। ভাঙারি কুড়িয়ে বিক্রি করে তাঁর জীবন চলে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পরেও তিনি স্টেশন ছেড়ে যাননি। শান্তা বলেন, ‘আমাদের পাশে কেউ নেই। আমরা রাস্তায় থাকি। ভোটার আইডি কার্ড ছিল, সেটিও হারিয়ে গেছে। যাঁরা আমাদের এই টিকা দিচ্ছে তাদের ধন্যবাদ।’

ভাসমান এসব মানুষকে দেওয়া হচ্ছে জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের করোনার টিকা। ঢাকা, ৬ ফেব্রুয়ারি
ছবি: দীপু মালাকার

কমলাপুর স্টেশনের ভাসমান মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনাকালে তাঁরা স্টেশনেই দিন-রাত পার করেছেন। তাঁদের অনেকের জ্বর, সর্দি, কাশিও হয়েছে। অসুস্থ হলে তাঁরা স্টেশনের আশপাশের এলাকার ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান। তেমনই একজন ৬৫ বছর বয়সী জায়েদা খাতুন। তিনি ৩৪ বছর ধরে কমলাপুর স্টেশনে থাকছেন। হুইলচেয়ারে করে চলাচল করেন জায়েদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার মধ্যে আমার দুইবার জ্বর আসছে। রাস্তার উল্টো পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাইছি। রাস্তায় থাকি, এখনো পর্যন্ত সুস্থ আছি।’

দেশে ভাসমান মানুষের সঠিক সংখ্যা নেই। তাঁদের জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্থায়ী ঠিকানা নেই। তাই তাঁদের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া নিশ্চিত করাটাও কঠিন। সে করণে ভাসমান মানুষকে জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির এক ডোজের টিকা দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় ভাসমান মানুষদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এর সহযোগিতায় আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং সমন্বয় করছে ব্র্যাক। এ কার্যক্রমে আরও যুক্ত আছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও সাজেদা ফাউন্ডেশন।

ভাসমান ব্যক্তিদের করোনার টিকা দেওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র লাগছে না
ছবি: দীপু মালাকার

টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার পর ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির ব্যবস্থাপক মিরানা জামান প্রথম আলোকে বলেন, রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে টিকাদান কর্মসূচি। কমলাপুরের পাশাপাশি মানিকনগর মডেল স্কুল, মুগদা ফিশ মার্কেট ও মুগদা স্টেডিয়াম মার্কেটে ভাসমান মানুষদের টিকা দেওয়া হবে।

রাত আটটার দিকে এ টিকাদান কর্মসূচি দেখতে আসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জনসনের এই টিকা একটা দিলেই সুরক্ষিত থাকবেন তাঁরা। সরকারে কাছে ৬ লাখ ৩৬ হাজার জনসনের টিকা আছে। পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাসমান মানুষকে টিকা দেওয়া হবে।

ভাসমান ব্যক্তিদের করোনার টিকা দেওয়ার পর তাঁদের হাতে হাতে টিকা কার্ড দেওয়া হচ্ছে
ছবি: দীপু মালাকার

৩৫ বছর বয়সী মো. এমরান কখনো থাকেন স্টেডিয়াম এলাকায়, কখনো রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়। পক্ষাঘাতগ্রস্ত এই ব্যক্তি হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে–ফিরতে পারেন না। টিকা দেওয়া হবে শুনে বিকেলে আরেক ভাসমান ব্যক্তির সঙ্গে কমলাপুরে এসেছেন। এমরান বলেন, ‘খুব ভালো লাগতেছে। গতকাল শুনেছি টিকা দেওয়া হবে। খুশি হয়ে আসছি। কোনো কার্ড বা কাগজ লাগবে না। এমনভাবে টিকা পাব আশা করিনি।’

ডান হাতে টিকা নিয়েছেন কমলাপুর স্টেশনের ক্লিনার মো. শাকিল সরকার। তিনি জন্মের পর থেকে ২৩ বছর ধরেই স্টেশনে থাকেন। শাকিল বলেন, ‘ছোটবেলায় একবার টিকা নিছিলাম। গত বছর টিকা দিতে গিয়েও পারিনি ভোটার আইডি কার্ড নেই বলে। টিকা দিয়ে খুব ভালো লাগতাছে।’