টিকাদানে গতি কম
টিকাদানে গতি বাড়াতে সারা দেশের ইপিআই কেন্দ্র পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ।
দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। এই সময় বেশি মানুষের টিকা দেওয়া থাকলে সংক্রমণ ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি কম থাকত। স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে পর্যাপ্ত টিকাও আছে। কিন্তু তারা দ্রুত বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারছে না। সর্বশেষ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কেন্দ্র ব্যবহার করেও টিকাদানে গতি বাড়াতে পারেনি তারা।
আপাতত টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ পিছিয়ে আছে। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি করোনার গণটিকাদান শুরু করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, এ পর্যন্ত দেশের ৪৪ শতাংশ মানুষ এক ডোজ এবং ৩১ শতাংশ মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ করোনার টিকা পেয়েছেন। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চায় সরকার।
শুরুর দিকে দেশে পর্যাপ্ত টিকা আসা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। গত দুই মাসে সেই অনিশ্চয়তা অনেকটাই দূর হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে ২২ কোটি ২ লাখ ৩৭ হাজার। ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ মিলে ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৭২ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ৮ কোটি ৮৬ লাখ ডোজের বেশি টিকা মজুত আছে। আগামী মার্চের মধ্যে আরও ৯-১০ কোটি টিকা আসার সম্ভাবনার কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
একটি বড় কর্মসূচি বাস্তবায়নে জাতীয়ভাবে, জেলা পর্যায়ে, উপজেলা পর্যায়ে এবং ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা দরকার।
টিকার মজুত নিশ্চিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১ জানুয়ারি থেকে সারা দেশের ইপিআই কেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। এক মাসে ৩ কোটি ৩২ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসাবে প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ ১ থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮০ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা। অর্থাৎ নিয়মিত করোনার টিকা দেওয়া ছাড়াও দৈনিক আরও ১৩ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাস্তবে তা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ১ থেকে ৬ জানুয়ারি সারা দেশে ৩২ লাখ ৭৪ হাজার মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর আগের সপ্তাহেও প্রায় একই পরিমাণ প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হয়েছিল। এতে দেখা যাচ্ছে, আগের সপ্তাহের চেয়ে সর্বশেষ সপ্তাহে মাত্র ৩ হাজার বেশি মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছে। পরপর দুই সপ্তাহের পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার যে ইপিআই কেন্দ্রগুলো করোনার টিকার জন্য ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ।
গত তিন মাসে টিকাদানের হার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দৈনিক টিকাদানের পরিমাণ কিছুটা বাড়তির দিকে। কিন্তু দ্রুত সব মানুষকে টিকার আওতায় আনার জন্য তা যথেষ্ট নয়।
ইপিআই কেন্দ্রে মানুষ আসছে না
এ বছর টিকাদানের গতি বাড়াতে ইপিআই কেন্দ্রগুলোকে নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের বড় পরিকল্পনা ছিল। সে অনুযায়ী প্রথম সপ্তাহে ৮০ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টিকা পেয়েছে মাত্র কয়েক হাজার মানুষ।
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার সিভিল সার্জন প্রথম আলোকে বলেন, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ে সিনোফার্মের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইপিআই কেন্দ্রে সিনোভ্যাকের টিকা দেওয়া হবে। এই দুই ধরনের টিকা মাঠপর্যায়ে আনা-নেওয়ার জটিলতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি আছে। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহে ইপিআই কেন্দ্রে সিনোভ্যাকের টিকাদান শুরুর সম্ভাবনা আছে।
খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, উপজেলায় ৬০ শতাংশের বেশি মানুষকে ইতিমধ্যে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। টিকা নিতে বেশি মানুষ বাকি নেই। তাই উপজেলার সব ইপিআই কেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া শুরু করলেও দৈনিক বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া যাচ্ছে না।
খুলনা জেলার দক্ষিণের একটি উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য বিভাগের এক মাঠকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ইপিআইয়ের নিয়মিত টিকা দেওয়ার পরদিন একই কেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু করোনার টিকার ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণা কম।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে চেষ্টা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
টিকা নিবন্ধনও কম হতে দেখা যাচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ১৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের নিবন্ধন হওয়া দরকার। এ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন সনদের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছেন ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ হাজার ৪৮৯ জন। অর্থাৎ প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ এখনো টিকার জন্য নিবন্ধনই করেননি। অন্যদিকে নিবন্ধন করা প্রায় ১৬ লাখ মানুষ টিকার প্রথম ডোজের অপেক্ষায় আছেন। আর দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন ২ কোটি ২৮ লাখের বেশি মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, একটি বড় কর্মসূচি বাস্তবায়নে জাতীয়ভাবে, জেলা পর্যায়ে, উপজেলা পর্যায়ে এবং ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা দরকার। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের টিকা কর্মসূচিতে যুক্ত করতে পারলে টিকাদানে গতি আসবে।