টিকায় গতি বাড়াতে নতুন লক্ষ্যমাত্রা

করোনার টিকা নিয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দরকার।

করোনাভাইরাসের টিকা নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে।
ছবি: সাজিদ হোসেন

দেশের মানুষের সামনে আবারও করোনার টিকাদানের নতুন লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে আট কোটি মানুষকে দুই ডোজ করে টিকা দেওয়া হবে।

অবশ্য টিকা আসার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ঘোষণা কার্যকর হতে দেখা যায়নি। আগামী সাড়ে তিন মাসে টিকাদানের নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দৈনিক ১০ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দিতে হবে। গত আট মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে তিন লাখের কম টিকা দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধন করা অনেক মানুষ টিকা পাচ্ছেন না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু মিয়ানমারের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১০ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দিতে পেরেছে। অবশ্য সরকারের লক্ষ্য দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা। সেই হিসাবে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে।

১৪ দিনের ব্যবধানে ২ কোটি বাদ

রাজধানীর মহাখালীর বিসিপিএস চত্বরে গতকাল রোববার আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক টিকাদানের নতুন লক্ষ্যমাত্রার কথা শোনান। তিনি বলেন, আগামী চার মাসের মধ্যে ৮ কোটি মানুষ দুই ডোজ করে টিকার আওতায় আসবে।

যদিও ২৬ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। ১৪ দিন পরে এসে দেখা যাচ্ছে, আগের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২ কোটি মানুষ বাদ পড়ে যাচ্ছে।

টিকা এসেছে ৭ কোটি ২২ লাখ। প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৮১ লাখ। দৈনিক ১০-১৫ লাখ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা।

কত মানুষকে টিকার আওতায় আনা হবে, গরমিল শুধু সেই ঘোষণায় নয়; কখন কোন টিকা কত আসবে, সে বিষয়েও তারতম্য দেখা যাচ্ছে। যেমন গতকালের সংবাদ ব্রিফিংয়ে দেশে কোন মাসে কত টিকা আসবে, তার হিসাব তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চলতি মাসে আসা টিকার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ কোটির বেশি। নভেম্বরে আসবে ৩ কোটি ৭৫ লাখ। ডিসেম্বরে আসবে ৫ কোটি টিকা। আর জানুয়ারিতে আসবে পৌনে ৪ কোটি টিকা। অর্থাৎ জানুয়ারির মধ্যে কমবেশি ১৬ কোটি টিকা দেশে আসবে। এসব টিকার মূল্য বাবদ অর্থ পরিশোধ করাও হয়ে গেছে বলে মন্ত্রী জানান।

দেশে টিকা আসা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আগের বক্তব্য সব মেলেনি। গত ১০ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে দেশে ১ কোটি ১০ লাখ টিকা আসবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহে টিকা এসেছিল ৬০ লাখের কিছু বেশি।

এরপর গত ২৪ জুলাই বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাশিয়া থেকে সাত কোটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসনের সাত কোটি টিকা আসবে। সেই টিকার বিষয়ে এখন আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী অন্য টিকার কথা জানালেও ওই দুই টিকা সম্পর্কে কিছু বলেননি।

বাস্তব পরিস্থিতি

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হিসাবে দেশে এ পর্যন্ত টিকা এসেছে ৭ কোটি ২২ লাখ। গতকাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৯৯ হাজার মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দিয়েছে। দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন ১ কোটি ৮১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। এ পর্যন্ত মোট ৫ কোটি ৪৭ লাখ ২৯ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে করোনার টিকা প্রথম এসেছিল গত ২১ জানুয়ারি। সর্বশেষ চালান এসেছে ৯ অক্টোবর। সবচেয়ে বেশি টিকা এসেছে সেপ্টেম্বর মাসে—২ কোটি ৫১ লাখের কিছু বেশি।

টিকাদানে ধীরগতি

গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে ৮০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছিল। টিকাদানের এই সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে একবারে বেশিসংখ্যক টিকা কখনো আসেনি। এক চালানে এক লাখ টিকা এসেছে এমন নজিরও আছে। বড় মজুত না থাকায় টিকাদানের গতি বাড়াতে সব সময় শঙ্কায় থেকেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করেই প্রথম ডোজ দিতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এখন বলছে মাসে তিন বা চার কোটি টিকা আনবে। এই পরিমাণ টিকা এলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টিকাদানের গতি বাড়াতে পারবে।

অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল বলেন, দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া প্রতি মাসে বড় আকারে গণটিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।

দরকার নিশ্চয়তা

স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল বলেছেন, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের টিকা দেওয়া হবে। দিন-তারিখ ঠিক না হলেও শিগগির এই বয়সীদের টিকা দেওয়া শুরু হবে। এদের মূলত ফাইজার ও মডার্নার টিকা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীরা টিকার জন্য জন্মনিবন্ধন সনদের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পারবে। নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সহজ করার জন্য আইসিটি বিভাগকেও বলা হয়েছে।

সব মিলিয়ে আগামী জানুয়ারির মধ্যে আট কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হলে আরও সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ টিকার অপেক্ষায় থাকবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে অন্যদের টিকার আওতায় আনা হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারির শুরু থেকে আমরা অনেক প্রতিশ্রুতির কথা শুনেছি। টিকার ক্ষেত্রেও অনেক আশাবাদ শোনানো হয়েছে। বাস্তবে অনেক কিছুই হয়নি। নতুন করে প্রতি মাসে যে পরিমাণ টিকা দেশে আসার কথা বলা হচ্ছে, আমরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই।’