থাই গ্লাসের দরজার একপাশে মা, আরেক পাশে দানিয়েল

থাই গ্লাসের দরজার একপাশে মা, আরেক পাশে দানিয়েল—এভাবেই মা ও ছেলের দেখা হচ্ছে
ছবি: সংগৃহীত

দানিয়েলের বয়স মাত্র সাত মাস। মায়ের বুকের দুধ খায়। রাতে মায়ের বুকে ঘুমায়। তবে কয়েক দিন ধরে দানিয়েলের পৃথিবীটা পালটে গেছে। মা তানিয়া সুলতানা দানিয়েলকে কাছে যেতে দেন না। থাই গ্লাসের দরজার একপাশে মা, আরেক পাশে দানিয়েল—এভাবেই মা ও ছেলের দেখা হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরপর মায়ের অস্পষ্ট মুখটা দেখিয়ে নিয়েই দানিয়েলকে শান্ত রাখতে হচ্ছে।
করোনা পজিটিভ হয়ে তানিয়া ৬ এপ্রিল থেকে ঘরবন্দী। কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা শুধু তানিয়া নন, ওয়ান ব্যাংকের কর্মকর্তা স্বামী কাজী ইলিয়াসেরও করোনা পজিটিভ। তিনিও বাসার আরেক ঘরে বন্দী।

গতকাল সোমবার সকালে মুঠোফোনে কথা বলার সময় তানিয়া সুলতানা বললেন, দানিয়েলেরও জ্বর, কাশি ছিল। চিকিৎসক তাকে দেখে বলেছেন সেও করোনা পজিটিভ। তবে ব্যথা পাবে বলে তার করোনা টেস্ট করেননি চিকিৎসক। তবে এক-দুই দিনের মধ্যে দানিয়েলের জ্বর কমে গেলে চিকিৎসক দানিয়েলকে আলাদা রাখার পরামর্শ দেন। তারপর থেকেই রাজধানীর বনশ্রীর বাসায় শুরু হয়েছে মা ও ছেলের যুদ্ধ।

ইলিয়াস ও তানিয়া দম্পতির মেয়ে আনশাহার বয়স ১১ বছর। মেয়ে পরিস্থিতি বুঝতে পারছে, তাই তাকে নিয়ে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।

তানিয়া জানালেন, তাঁর বাবার বয়স ৭৪, আর মায়ের বয়স ৬০ বছর। এ ছাড়া বাসায় এক বোন আছেন। তাঁরাই দুই বাচ্চাকে সামলে রাখছেন। বাবা ও মায়ের বয়স বেশি হওয়ায় তাঁদের নিয়ে ভয় তো আছেই। গত বছর মা করোনা পজিটিভ হলে বাসায় চিকিৎসা নিয়েই ভালো হন।

তানিয়া কথা বলার সময় কাশছিলেন। জানালেন, রাতে অক্সিজেন না দিলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। স্বামীরও নানান শারীরিক জটিলতা চলছে।

দানিয়েল বুকের দুধ খায়, হুট করে খাওয়া বন্ধ রাখায় তানিয়াকে বুকের দুধ চিপে ফেলে দিতে হচ্ছে। শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি তখন শুরু হয় মানসিক কষ্ট। বললেন, যারা বা যে পরিবার করোনার কবলে পড়েনি, তারা এই কষ্ট ও ভোগান্তির কথা চিন্তাও করতে পারবে না।

চার সদস্যের পরিবার, যখন করোনা আঘাত হানেনি
ছবি: সংগৃহীত

তানিয়া এবং তাঁর স্বামীর অফিস মতিঝিলে। তানিয়া জানালেন, ব্যাংকগুলোতে ভিড় এড়ানো কঠিন। মানুষও অসচেতন। মাস্ক পরতে বললে উল্টো রাগ দেখান। তানিয়া নিজে দুটি মাস্ক পরেও করোনা পজিটিভ হয়েছেন বলে পরিচিতদের মধ্যে অনেকে হাসাহাসিও করেছেন।

তানিয়া তাঁর কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, জ্বর ও কাশির কথা জানানোর পর থেকেই অফিসের নীতিনির্ধারকেরা তাঁকে অফিসে যেতে নিষেধ করেছেন।

তানিয়া বললেন, অনেক অফিস কর্মীদের করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে না আসা পর্যন্ত অফিস করতে বাধ্য করছে, অনেকে আবার নিজেরাই পাত্তা দিচ্ছেন না। জ্বর, কাশির কথা গোপন করে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
আইসোলেশনে ঘরবন্দী থাকলেও চারপাশে করোনায় মৃত্যুর সংবাদগুলো তানিয়ার কানে যাচ্ছে। বললেন, এখন পর্যন্ত নিজের আপনজনের মৃত্যু হয়নি করোনায়। কিন্তু রাত হলেই নিজের ও স্বজনদের নিয়ে মৃত্যুচিন্তা বুকে চেপে বসে। চোখের সামনে সন্তানদের মুখ ভাসতে থাকে।