দেশে পিছিয়ে যাচ্ছে চীনা টিকার পরীক্ষা

করোনার টিকার প্রতীকী ছবি

দেশে চীনা টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ (ট্রায়াল) কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে। টিকা উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা শুরুর আরও প্রস্তুতির জন্য সময় চেয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছে। অন্যদিকে ফরাসি কোম্পানি সানোফি তাদের টিকার পরীক্ষা করার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে সভা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনের টিকা উদ্ভাবন ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক চিঠিতে আর্থিক সমস্যার কথা জানিয়ে পরীক্ষায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থায়নের কথা বলেছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সরকারের কী সিদ্ধান্ত হয়, সিদ্ধান্তের পর কবে নাগাদ পরীক্ষা শুরু হতে পারে, তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা (সিনোভ্যাক) প্রস্তুতির জন্য সময়ের কথা বলে চিঠি দিয়েছে। বিষয়টি ওপরে পাঠানো হয়েছে।’

সিনোভ্যাক টিকার পরীক্ষার বিষয়ে চুক্তি করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সঙ্গে। সূত্র বলেছে, যৌথ অর্থায়নবিষয়ক চিঠি এসেছে আইসিডিডিআরবির কাছে। সেই চিঠি আইসিডিডিআরবি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। পরীক্ষার বিষয়ে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চিঠিতে সিনোভ্যাক আর্থিক সমস্যার কথা তুলেছে এবং চিঠির উদ্দেশ্য পরীক্ষায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অর্থায়ন।

সিনোভ্যাকের টিকার নাম ‘করোনাভ্যাক’। এ টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল ব্রাজিলে। এরপর শুরু হয় ইন্দোনেশিয়ায়। অতিসম্প্রতি শুরু হয়েছে তুরস্কে। তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় টিকা কতটুকু নিরাপদ ও কার্যকর, তা গবেষণার মাধ্যমে দেখা হয়। এ পর্যায়ের পরীক্ষার জন্য সামাজিক সংক্রমণ বজায় থাকার প্রয়োজন হয়। ওপরের তিনটি দেশের মতো বাংলাদেশে এখনো সামাজিক সংক্রমণ আছে। চীনে সামাজিক সংক্রমণ নেই। তাই চীনের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের টিকার পরীক্ষা হচ্ছে সামাজিক সংক্রমণ বজায় আছে এমন দেশগুলোতে।

কোভিড–১৯ নিরাময়ে সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। করোনাভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তিকে সুস্থ করতে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ এখনো তৈরি হয়নি। চিকিৎসক, রোগতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে স্থায়ী সমাধান দিতে পারে টিকা।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠানগুলো টিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে।

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে টিকার ব্যাপারে আগ্রহ আছে। সাধারণ মানুষও জানতে চায়, টিকা কবে আসবে, টিকার দাম কত হতে পারে, দেশের সব মানুষ টিকা পাবে কি না, দেশের সব মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে।

সরকার ইতিমধ্যে রাশিয়া, চীন ও ভারত থেকে টিকা আনার ব্যাপারে যোগাযোগ করেছে। করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে টিকা সংগ্রহের ব্যাপারেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্যসচিব (সেবা বিভাগ) আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেছেন, সিনোভ্যাক ছাড়াও ভারতের কোম্পানি ভারত বায়োটেক এবং ফ্রান্সের সানোফি বাংলাদেশে তাদের টিকার পরীক্ষার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।

আইসিডিডিআরবি রাজধানীর সাতটি হাসপাতালে ৪ হাজার ২০০ স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর চীনা টিকার পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি হাসপাতালে পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিট-১, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিট-২, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল। আরও দুটি হাসপাতাল যুক্ত করা হবে বলে জানা গেছে। আইসিডিডিআরবি প্রায় ২৫০ মাঠ গবেষক নিয়োগ দিয়েছে। পুরো গবেষণার জন্য ৭ মিলিয়ন ডলারের (৫৯ কোটি ৫০ লাখ) একটি প্রকল্প তৈরি কাজ শুরু করেছে আইসিডিডিআরবি।

আইসিডিডিআরবির সঙ্গে সিনোভ্যাকের চুক্তিতে বলা আছে, পরীক্ষায় নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলে সিনোভ্যাক ১ লাখ ১০ হাজার টিকা বাংলাদেশকে বিনা মূল্যে দেবে। এ ছাড়া টিকা তৈরির প্রযুক্তিও বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা তাতে আছে।

টিকা পরীক্ষার মুখ্য গবেষক এবং আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী কে জামান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, আইসিডিডিআরবির প্রস্তুতি প্রায় শেষ, চীন থেকে টিকা আসার অপেক্ষা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইসিডিডিআরবির সূত্র বলছে, সিনোভ্যাকের পক্ষ থেকে আসা চিঠি অস্বস্তি তৈরি করেছে। আইসিডিডিআরিব উদ্যোগ–আয়োজন কিছুটা স্থগিত হয়ে আছে।

এদিকে কোভিড–১৯–বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ১৭ সেপ্টেম্বরের সভায় বলা হয়, আইসিডিডিআরবির সঙ্গে টিকার পরীক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মতো উপযুক্ত ও দক্ষ প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা প্রয়োজন। পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ওষুধ বা টিকার পরীক্ষার ব্যয় বহন করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। এ ক্ষেত্রের চীনা কোম্পানির উচিত দ্রুত অর্থের ব্যবস্থা করে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা শেষ করা।

চীনা কোম্পানির প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখা হবে। আর ফরাসি কোম্পানি সানোফির সঙ্গে টিকার পরীক্ষার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী

সাধারণত বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) নীতিগত অনুমোদন পেয়েই কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা শুরু করতে পারে। কিন্তু বিএমআরসির নীতিগত অনুমোদন পেলেও পরীক্ষার প্রস্তুতির কাজ শুরু করতে পারেনি আইসিডিডিআরবি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মহামারির জরুরি প্রস্তুতিতে বিএমআরসির অনুমোদনই যথেষ্ট নয়। আর পরীক্ষার জন্য চীনা কোম্পানি বাংলাদেশকে কী পরিমাণ অর্থ দেবে, এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এখন উল্টো চীনা কোম্পানি টাকার কথা বলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনা কোম্পানির প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখা হবে। আর ফরাসি কোম্পানি সানোফির সঙ্গে টিকার পরীক্ষার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, টিকার ব্যাপারে চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে কথা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে।