নবম মাসে মৃত্যু বেড়েছে ৩৩%

৯ মাসেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মৃত্যুর হার কমেনি। চিকিৎসা–সুবিধা খুব একটা বাড়েনি।

মাঝে দুই মাস দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা কমলেও এখন তা আবার ঊর্ধ্বমুখী। আগের মাসের তুলনায় সংক্রমণের নবম মাসে করোনায় মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। এই সময়ে নতুন রোগী বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণের তথ্য জানানো হয় গত ৮ মার্চ। আজ মঙ্গলবার সংক্রমণ শনাক্তের ৯ মাস পূর্ণ হচ্ছে। এই ৯ মাসেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

মহামারির শুরু থেকে সংক্রমণ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা শনাক্তের পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ), কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আলাদা করা), আইসোলেশনের (বিচ্ছিন্ন রাখা) ওপর জোর দিয়ে আসছে। কিন্তু দেশে শুরু থেকেই এসব উদ্যোগের ঘাটতি ছিল।

৯ মাসেও দেশের সব জেলায় কোভিড–১৯ শনাক্তের পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারিত করা যায়নি। সব জেলা সদর হাসপাতালে চালু করা যায়নি নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা। করোনার টিকা না আসা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বিশেষত মাস্ক পরাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও ঢিলেঢালা ভাব। জনগণকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করা যায়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এখনো পরীক্ষা পর্যাপ্ত নয়। প্রতিটি উপজেলা থেকে প্রতিদিন অন্তত ২৫টি এবং বড় শহরগুলোতে শতাধিক নমুনা নিয়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সব জেলায় আইসিইউ করার কথা, কতটিতে হয়েছে, তা জানা নেই। মৃত্যুর হার কমেনি। চিকিৎসা–সুবিধা খুব একটা বাড়েনি। মানুষ মাস্ক পরছেন না। তিনি বলেন, ৯ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ৯ মাসে করোনার বিরুদ্ধে তেমন কিছুই করা যায়নি।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তিন মাসের মধ্যে তারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনে। চীনের পর সবচেয়ে করোনার বেশি প্রকোপ দেখা গিয়েছিল ইউরোপের দেশগুলোতে। সেখানকার দেশগুলো তিন থেকে চার মাসের মাথায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু এখন ইউরোপে আবার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় প্রথমবারের চেয়ে বেশি সংক্রমণ হচ্ছে।

বাংলাদেশে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে। জুনে তা তীব্র আকার ধারণ করেছিল। মাস দুয়েক সংক্রমণ কমার পর নভেম্বরের শুরু থেকে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী। তবে দেশে এখনো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগের মাসের চেয়ে সংক্রমণের নবম মাসে (৯ নভেম্বর থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত) নতুন রোগী, রোগী শনাক্তের হার, মৃত্যু—সবই বেড়েছে। এ মাসে ৫৯ হাজার ৫০৫ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে; যা আগের মাসের তুলনায় ৩০ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। এই মাসে মারা গেছেন ৮০৭ জন, যা আগের মাসের তুলনায় ৩২ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি। এই এক মাসে পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় দেশে মোট ২ হাজার ১১৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৩৬ জন।

সংক্রমণ যখন কমে এসেছিল, তখন থেকেই সরকার বলে আসছিল, শীতে আবার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংক্রমণ মোকাবিলায় এখনো পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (এমআইএস) হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব উপজেলা থেকেই নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিন্তু চাইলেই সব জেলায় দ্রুত আরটিপিসিআর ল্যাব করা সম্ভব নয়। এখন প্রতিদিন ৫০ হাজার পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। কিন্তু সে পরিমাণ নমুনা আসছে না। মাস্কের বিষয়ে তিনি বলেন, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক—এই বার্তা দেশের সবখানে ছড়িয়ে দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সক্ষম হয়েছে।

পরীক্ষা বাড়েনি, নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেনে ঘাটতি

সংক্রমণ প্রতিরোধে একেবারে শুরু থেকেই সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা করানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির মাপকাঠিতে একজন রোগী শনাক্তের বিপরীতে যদি ১০ থেকে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়, তাহলে পরীক্ষা পর্যাপ্ত হচ্ছে বলে ধরা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে একজন রোগী শনাক্তের বিপরীতে ছয়টি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

শুরুতে শুধু সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) পরীক্ষা করা হতো। পরে পরীক্ষার সুবিধা বাড়ানো হয়। তবে দেশের সব জেলায় পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণের কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি। দ্রুততম সময়ে রোগ শনাক্তের পদ্ধতি অ্যান্টিজেনভিত্তিক পরীক্ষা চালু হয়েছে প্রায় ৯ মাস পর। গত শনিবার থেকে ১০টি জেলায় এই সুবিধা চালু হয়েছে। এখনো দেশের ২৯টি জেলায় আরটিপিসিআর বা অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সুবিধা নেই। এখন পর্যন্ত পরীক্ষার যে সুবিধা, তার বেশির ভাগই ঢাকায়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ১১২টি পরীক্ষাগারে আরটিপিসিআর পরীক্ষার সুযোগ আছে। এর মধ্যে ৬৬টিই ঢাকায়। আবার এই ১১২টি পরীক্ষাগারের মধ্যে ৫৭টিই বেসরকারি ব্যবস্থাপানায় পরিচালিত হয়। যেখানে পরীক্ষার ফি বেশি।

গত জুনে সরকার নতুন করে ৭৯টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগ এখনো হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ হোসেন মিয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত মোট ৫৯টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা আছে। আরও ৬৫টি হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। যার ৩০টিতে এখনো কাজ শুরু হয়নি। বাকিগুলোতে কাজ চলছে।

মাস্কে অনীহা

সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হলো মাস্ক পরা। কিন্তু মাস্ক পরার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে। বিশেষত গ্রাম এলাকায় মাস্কের ব্যবহার নেই বললেই চলে। মাস্ক পরা বাড়াতে গত ২৫ অক্টোবর ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। বেশ কিছুদিন থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হচ্ছে। যাঁরা মাস্ক পরছেন না, তাঁদের জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত চলে গেলে মানুষ মাস্ক খুলে ফেলছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাস্ক পরার ক্ষেত্রে মানুষের যেমন অনীহা রয়েছে, তেমনি তাঁদের উদ্বুদ্ধকরণেও রয়েছে ঘাটতি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু জরিমানা করে মাস্ক পরায় সচেতনতা তৈরি করা যাবে না। এ জন্য লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। শনাক্ত রোগীদের সার্জিক্যাল মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের সংস্পর্শে যাঁরা ছিলেন বা পরিবারের সদস্য, তাঁদের সবাইকে কাপড়ের মাস্ক দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের কিছু পদক্ষেপের ফলে সংক্রমণ মাঝখানে ধীর করা গেছে। সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মাঠপর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের জনবল এবং জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল; যেটা পরিপূর্ণভাবে করা যায়নি।