পরিবহনশ্রমিকদের টিকার বিষয়ে তথ্য নেই

যানবাহন চালাতে চালক-সহকারীর টিকা সনদ বাধ্যতামূলক। কিন্তু কারা টিকা পেয়েছেন, কারা পাননি—সেই তথ্য নেই। ভাড়া-নৈরাজ্যের আশঙ্কাও রয়েছে।

করোনার টিকা
প্রতীকী ছবি

গণপরিবহন চালাতে হলে চালক ও সহকারীদের বাধ্যতামূলকভাবে করোনার টিকার সনদ থাকতে হবে—মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা এমনই। কিন্তু কত শ্রমিক-কর্মচারী টিকা পেয়েছেন, কারা বাকি আছেন—এ-সংক্রান্ত তথ্য গণপরিবহন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে নেই। এমনকি এই খাতের যাঁরা টিকা নেননি, তাঁদের অগ্রাধিকারের আওতায় আনার বিশেষ কোনো কর্মসূচিও নেই সরকারের।

বাস, লঞ্চ ও ট্রেনের মতো গণপরিবহনের পাশাপাশি শহর ও গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতে অটোরিকশা, টেম্পো, লেগুনাও অনেক মানুষ ব্যবহার করে। এই পরিস্থিতিতে শুধু টিকা নিয়েছেন, এমন চালক-শ্রমিকেরাই এসব গণপরিবহন চালাবেন—এই নির্দেশনা কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্নও উঠেছে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকার কড়াকড়ি আরোপ করলে গণপরিবহনে সংকট তৈরির আশঙ্কা করছেন এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সে ক্ষেত্রে টেম্পো, লেগুনা ও হিউম্যান হলারে গাদাগাদি করে বেশি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন বেড়ে যেতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ। ১২-১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে কত টিকা দেওয়া হয়েছে, এর একটা হিসাব আছে সরকারের। বাকিদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন দেশে পর্যাপ্ত টিকা আছে। শ্রমিকেরা চাইলে সহজে টিকা নিতে পারেন। এরপরও পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো সরকারের সঙ্গে কথা বলে টার্মিনালে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। পরিবহন খাতে বাধ্যতামূলক টিকা সনদের বিষয়ে প্রথম দিকে কিছুটা শিথিলতা দেখানো দরকার হতে পারে। এর মধ্যে সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

পরিবহন খাতের নেতারা বলছেন, গণপরিবহন খাতের চালক, শ্রমিক ও কর্মচারীরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। তাঁদের মধ্যে শিক্ষার হারও কম। টিকা নেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রেও তাঁদের সচেতনতা কম।

পরিবহন খাতে বাধ্যতামূলক টিকা সনদের বিষয়ে প্রথম দিকে কিছুটা শিথিলতা দেখানো দরকার হতে পারে। এর মধ্যে সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
ডা. মুশতাক হোসেন পরামর্শক, আইইডিসিআর

করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গত সোমবার রাতে ১১ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এর একটি দফায় বলা হয়েছে, বাস, ট্রেন ও লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী বহন করা যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে কার্যকারিতার সুনির্দিষ্ট তারিখসহ নির্দেশনা জারি করবে। সব ধরনের যানের চালক ও সহকারীদের অবশ্যই কোভিড টিকাধারী হিসেবে সনদ থাকতে হবে।

পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও এর সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১১ দফা নির্দেশনাসংবলিত প্রজ্ঞাপনটিই তাদের কাছে সম্বল। এটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এই বিষয়ে কারও কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই।

এই পরিস্থিতিতে আজ বুধবার বেলা আড়াইটায় বনানীর বিআরটিএ কার্যালয়ে পরিবহনমালিক, শ্রমিকনেতাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। বিআরটিএ কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই বৈঠকে টিকা কীভাবে দেওয়া হবে, সেটা গুরুত্ব না–ও পেতে পারে। অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চললে ভাড়া কত বাড়বে—এই আলোচনাই বেশি প্রাধান্য পাবে। কারণ, টিকা দেওয়ার এখতিয়ার বিআরটিএ বা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেই।

এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সব শ্রমিক টিকা দিয়েছেন কি না, এই তথ্য কারও কাছে নেই। আজকের (বুধবার) বৈঠকে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। একটা পথ বের করা যাবে। ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, জনগণের স্বার্থের বিষয়টি সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে।

শ্রমিকদের টিকা গুরুত্ব পায়নি

ঢাকার আবদুল্লাহপুর-গুলিস্তান পথে চলাচলকারী বাসের চালক মোক্তার হোসেন এখনো টিকা নেননি। থাকেন টঙ্গীতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোর ছয়টায় বাসে ওঠেন তিনি। ছুটি পান মধ্যরাতে। নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র কোথায় আছে, সেটাও জানেন না। ফলে টিকা নেওয়া হয়নি।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, সড়ক পরিবহন খাতে শ্রমিক প্রায় ৫০ লাখ। এর সঙ্গে যানবাহন মেরামতসহ নানা কাজে যুক্ত শ্রমিক আছেন আরও প্রায় ২০ লাখ। সব মিলিয়ে বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, নছিমন, করিমনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে শুধু যাত্রীবাহী বাসের শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখের মতো।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, চলন্ত অবস্থা বাদ দিলে শ্রমিকেরা বেশি সময় কাটান বাস টার্মিনালে। অনেকের বাসাও টার্মিনালের আশপাশের এলাকায়। এসব দিক বিবেচনা করে বাস টার্মিনালগুলোতে টিকাকেন্দ্র খুলে শ্রমিকদের টিকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি শ্রমিকদের কীভাবে টিকার আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের নিয়ে কোনো বৈঠকও হয়নি। সারা দেশে কত শ্রমিক টিকার আওতায় এসেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো হিসাব নেই।

একই অবস্থা যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী নৌযানের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাবে, এই খাতে শ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখের বেশি। তাঁদের মধ্যে কারা টিকা পেয়েছেন, কারা বাকি আছেন—এই তথ্য নেই। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি টার্মিনালে ভাগ করে টিকার বিশেষ কর্মসূচি নিলে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব।

রেলওয়েতে সার্বক্ষণিক ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত থাকা কর্মীদের ‘রানিং স্টাফ’ বলা হয়। এর মধ্যে চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিটিই, অ্যাটেনডেন্ট আছেন। এ ধরনের কর্মচারীর সংখ্যা দুই হাজারের মতো। তাঁরা সম্মুখসারির কর্মী হিসেবে আগে টিকা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই টিকার আওতায় এসেছেন বলে রেলের কর্মকর্তারা মনে করছেন।

ভাড়া নিয়েও জটিলতা

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে সরকার নগর পরিবহন ও দূরপাল্লার বাসে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছিল। কিন্তু মালিক-শ্রমিকেরা নিজে থেকে আরও বাড়িয়ে ভাড়া আদায় করছেন। বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহনের বাধ্যবাধকতায় আবারও ভাড়া–নৈরাজ্যের আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য রেলে ভাড়া বাড়ছে না। রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগামী শনিবার থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারির আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা বৈঠক করেছিলেন। সেখানে অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহনের বিনিময়ে ভাড়া বৃদ্ধি না করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। যদিও গত বছর অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহন করার সময় সব ধরনের বাসে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করলে ভাড়া বাড়াতে হবে। সব শ্রমিকের টিকার সনদ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে যেখানে অর্ধেক মানুষ টিকা পায়নি, সেখানে পরিবহন খাতে কীভাবে সবাই পাবে? আর সরকার তো তাদের জন্য বিশেষ কোনো কর্মসূচি নেয়নি।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, বিশেষ কর্মসূচি ছাড়া গণপরিবহনের শ্রমিক-কর্মচারীদের শতভাগ টিকার আওতায় আনা যাবে না। তবে বাস ও লঞ্চে ভাড়ার বিষয়টি যাত্রীদের ওপর বাড়তি বোঝা তৈরি করবে।

মালিকেরা ইতিমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির দাবি করছেন। ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি হলেও তা যাত্রীদের পক্ষে বহন করা কঠিন হবে। কারণ, এতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বাসের ভাড়া ২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। লঞ্চের ভাড়াও নাগালের বাইরে চলে যাবে।