বাঁচা ও বাঁচানোর লড়াই

নানা ধরনের চিকিৎসাযন্ত্র অনীক চন্দের কক্ষের চারদিকে। সেখানে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রী মনিকা চন্দ। গত শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের নন্দনকানন এলাকায়
ছবি: জুয়েল শীল

মায়ের চিতার আগুন তখনো পুরোপুরি হয়তো নেভেনি। শোক নিয়ে এক দিন পরই অনীক চন্দ ছুটলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে, করোনা রোগীদের সেবায়। তখন জুন মাস। চারদিকে মৃত্যুর খবর। একটানা কাজ করে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন অনীক নিজেও।

যে করোনা ওয়ার্ডে তিনি চিকিৎসা দিতেন, সেখানকারই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হলো অনীককে। অবস্থা দিনে দিনে খারাপের দিকে গেল। ৪ মাস ৯ দিন হাসপাতালে থাকতে হলো তাঁকে, মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা যাকে বলে। ২১ অক্টোবর বাসায় ফিরেছেন। এখনো লড়ে যাচ্ছেন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে। এখন বাসাতেই চলছে তাঁর চিকিৎসা।

নন্দনকাননের বাসায় অনীকের কক্ষটি যেন একটি হাসপাতালের কেবিন। অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র, সিলিন্ডার, বাইপ্যাপ মেশিন, অক্সিমিটার, ওষুধপথ্য—কী নেই সেখানে! চিকিৎসক স্ত্রী মনিকা চন্দ তাঁর দেখভাল, চিকিৎসা—দুটোই করছেন। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ ঘোষ, সরোজ চৌধুরী, নিতাই প্রসাদ দত্ত, ফারহানা আকতারের পরামর্শও নিচ্ছেন তাঁরা।

এখনো যে বেঁচে আছেন, তার কৃতিত্ব চিকিৎসকদের দিলেন অনীক। তাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশন এখন ৯০-এর ঘরে ওঠানামা করে। ঘরে দুই মিনিট হাঁটলে আরও কমে যায়। পেশিগুলো দুর্বল। ফুসফুসের সংক্রমণ এখনো সেরে ওঠেনি। ‘অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। খাবারে রুচি নেই। তবে আগের চেয়ে ভালো। হাসপাতালে সংক্রমণের আশঙ্কায় বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে আমাকে। এত দিন ধরে অসুস্থ। মাঝেমধ্যে অস্থির লাগে।’ বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলেন অনীক। বুকটা ওঠানামা করছে দ্রুত। পাশ থেকে ধরলেন মনিকা। অক্সিমিটার লাগিয়ে দিলেন। স্যাচুরেশন কমেছে। শুরুর সেই দিন থেকে মনিকা স্বামীর পাশে থেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। একদিকে সংকটাপন্ন স্বামীর সেবা, অন্যদিকে নিজের চিকিৎসা—দুটোই করতে হয়েছে হাসপাতালের পাশাপাশি বিছানায় থেকে।

২০২০ সালটি তাঁদের কাছে যেন বিভীষিকাময়। ৩ মার্চ বাবা অরুণ চন্দ বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যান। এরপর অনীকের ঘরের প্রতিটি সদস্যই ভুগেছেন করোনার উপসর্গে। মা, দুই ছেলে, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাইঝি—সবাই কমবেশি ভুগেছেন। আগে থেকে অসুস্থ মা জয়শ্রী চন্দ ১ জুন পরলোকে যান জ্বর ও তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে। শেষকৃত্য সেরে অনীক ৩ জুন হাসপাতালের কোভিড বিভাগে সেবা দিতে যান।

‘মা চলে যাওয়ার এক দিন পরই হাসপাতালে যোগ দিয়েছি। শরীর খারাপ ছিল। এক সপ্তাহ টানা হাসপাতালে যাই। পরে উপসর্গ বাড়তে থাকে। ১১ জুন মায়ের শ্রাদ্ধ করতে পারিনি। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। ১৩ জুন বাধ্য হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হতে হলো। ভর্তি হতে দেরি করে ফেলেছি।’ কিছুটা আফসোস নিয়ে বললেন অনীক।

হাসপাতালে অনীক ও মনিকার সংগ্রামী দিনগুলো এখনো তাঁদের আতঙ্কিত করে তোলে। এই ভালো তো এই খারাপ। নীরবে চোখের জল ফেলেছেন অসহায় মনিকা। হাল ছাড়েননি। প্রথম দিকে হাসপাতালে আরেকজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলায় অক্সিজেন দিতে হয়েছে তাঁকে।

সেই সময়টা নিয়ে মনিকা বলেন, ‘প্রতিটি রাত জেগেছি। কারণ হাই ফ্লো খুলে গেলে তাঁর অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। একবার সকাল ৭টায় স্যাচুরেশন ৪০-এ নেমে এল। তাঁর চোখ বুজে আসছিল। আমি বলেছি, চোখ বন্ধ করবে না। দ্রুত পুনরায় হাই ফ্লো অক্সিজেন দিয়ে নানা চেষ্টায় স্যাররা (চিকিৎসক) ওই যাত্রা বাঁচিয়েছেন অনীককে। এ রকম বেশ কয়েকবার হয়েছে।’

মনিকা বলেন, আরেকবার ৭ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় আগুন লাগে। পঞ্চম তলায় কোভিড কেবিনে তখন অনীক-মনিকা। শ্বাসকষ্টে বিছানা থেকে ওঠার শক্তি ছিল না। ওয়ার্ড থেকে সবাই নেমে গেছে। সৃষ্টিকর্তার হাতে ভাগ্যকে সঁপে দিয়ে এই দম্পতি কেবিনে বসে ছিলেন। আশপাশে চিকিৎসক সহকর্মীরাও তখন চিকিৎসা নিচ্ছেন। একদিন খবর এল, সহযোগী অধ্যাপক সমিরুল ইসলাম মারা গেছেন। অনীক তখন সংকটাপন্ন। এটা তাঁকে জানাতে নিষেধ করেছিলেন। সমিরুলের জন্য সহকর্মীদের হাহাকার তাঁর কানে পৌঁছে যায়। এসব মন খারাপ করা খবর নিজের জীবনশঙ্কা বাড়িয়েছে।

সেখান থেকে আপাতত প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন অনীক। মনিকা একটি বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে রোগী দেখেন। অনীককে ঘরে দুই শিশুসন্তানের কাছে রেখে চেম্বারে যান। মায়ের অনুপস্থিতিতে ষষ্ঠ শ্রেণির পাপাই অনীকের দেখভাল করে। মনিকার মন পড়ে থাকে ঘরে। শুধু স্বামী নয়, এখন চিন্তা ছেলে পাপাই ও টিনটিনকে নিয়েও।

মনিকা বলে গেলেন, ‘এখন নতুন সমস্যা হচ্ছে পাপাই। সে ভেঙে পড়েছে। দুঃস্বপ্নে মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে। সব সময় আতঙ্ক কাজ করে তার মধ্যে।’

বছরের শুরুতে কী প্রাণময় না ছিল তাঁদের নন্দনকাননের বাসাটি। চোখের সামনে দাদু-ঠাকুরমার মৃত্যু দেখেছে পাপাই, টিনটিনরা। বাবা পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। প্রাণহীন ঘরটিকে নানা উপায়ে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন মনিকা চন্দ।