বাঙালী, জাতি হিসেবে যেমন

প্রথম আলো ফাইল  ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ছোট বেলায় ইমদাদুল হক মিলনের একটা নাটক দেখেছিলাম নাম ছিল বারো রকম মানুষ। আজ দেখছি মানুষের রকমভেদ এত পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে যে এখন যদি বলি আমাদের চারপাশে হাজার রকমের মানুষ আছে তাও বোধহয় ভুল হবে।

 দেশে এক একটি বিপর্যয় ঘটে আর আমাদের হাজার রকমের মানুষদের কার্যকলাপ কখনো আমাদের হাসায়, কখনো কাদায় আবার কখনো বা দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলে।

 এবারের এই করোনাকালীন দুর্যোগে অনেকের বর্তমান ক্রিয়াকলাপ পূর্বেকার সকল ক্রিয়াকলাপকে পেছনে ফেলে রীতিমতো বাকরুদ্ধ করে ফেলেছে। সারা বিশ্ব যেখানে করোনা ভয়ে আতঙ্কিত সেখানে দুর্দান্ত সাহসী বাংলাদেশিরা করোনাকে বলল, করোনা মারাত্মক কোন রোগ নয়, এটা সাধারন সর্দি-কাশির মতো। কেউ কেউ আবার বিদেশ থেকে কারা করোনা নিয়ে আসছে, তারা দেখতে কেমন তা দেখার জন্য বিমানবন্দরে ভিড় জমাতে শুরু করলেন। কিন্তু এই দেখার মধ্যে বিশেষ কোনো পরিবর্তন খুঁজে না পাওয়ায় তাদের একদল হানা দিল সেই সকল বিদেশ ফেরত বাঙালীর ঘরের জানালায়। আর বিদেশ ফেরত বাঙালী ভাইয়েরা আরো এককাঠি উপরে। তারা এত টাকা খরচ করে করোনা বিদেশ থেকে দেশে নিয়ে এলো অথচ তা ছড়িয়ে দেবে না, তা কি হয়? তাইতো বিমানবন্দরে নেমেই তারা প্রিয়জনকে বুকে জড়িয়ে করোনাকে করজোড়ে অনুরোধ করে ছড়িয়ে দিল এক বুক থেকে হাজারো বুকে।

 যেহেতু, বুকে বুক জড়িয়ে দুই বুক ঘরে গিয়ে বন্দী হলে করোনার পুরো বাংলাদেশ দেখায় ভাটা পড়ত, তাই দেশপ্রেমিক বিদেশ ফেরত ভাইয়েরা করোনার বাংলাদেশ ভ্রমণ নিশিত করতে কেউ রওনা দিল শ্বশুরবাড়ি, আর কেউ করলো বিয়ে, কেউবা আবার আত্মীয়স্বজনদের খবর দিয়ে করোনাকে কৃপা করল ঘুরে বেড়াতে।

 এখন কথা হচ্ছে, আমরা যেহেতু আমাদের রেমিটেন্স প্রদান করা ভাইদের ঘরে আটকে রেখে তাদের মুন্ডু উদ্ধার করতে পারি নাই, তাই সহজ সমাধান হিসেবে সরকারের মুন্ডুপাত করতে একদল লোক আঁটসাঁট বেধে নেমে পড়লাম। এতে অবশ্য আমি দোষের কিছু দেখি না, পরিবারের প্রধান যেমন পিতা, তেমনি দেশের সরকার।

 করোনা প্রসঙ্গে শুরুতে যদি কঠোর হাতে বিদেশ ফেরত বাঙালীদের পায়ে জোর পূর্বক শেকল পরিয়ে কোয়ারেন্টিনের ১৪ দিন আটকে রাখা হতো। তারপর প্রত্যেককে নিজ নিজ ঘরে ছেড়ে দিয়ে আসা হতো, তাহলে আজ এই দুর্দিন হয়তো বাংলাদেশের দেখতে হতো না। জাতি হিসেবে আমরা অসাধু হলেও আবেগী। তাইতো, আত্মোতৃপ্তিই বলি আর আত্মসিদ্ধি, সেটা হাসিলের লক্ষ্যে এতটাই মরিয়া হয়ে যাই যে নিজের ভুলের বা আবেগ সংবরণ না করার কারনে দেশের বা দেশের মানুষের কতটুকু কি ক্ষতি হচ্ছে তা ভেবে দেখবার অবসরটুকুও পাই না। তাইতো জোর-জবরদস্তী করে কেউ বিমানবন্দর থেকে কেউ কেউ কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র থেকে যে যার বাড়ি চলে গেল। করোনার প্রকোপ যখন প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল সরকার দলীয় মন্ত্রী না হয় বলেইছিলেন করোনা ছোঁয়াচে নয়, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো করোনার করাঘাত কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা আঁচ করতে পেরে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেন। মানছি, পূর্বে যানবাহন বন্ধ না করে গার্মেন্টস বা অফিস আদালত বন্ধ দেওয়ায় করোনা ঝাঁকে ঝাঁকে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে। কিন্তু সরকার কি একবারের জন্যও এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বলেছে ছুটি দিচ্ছি সবাই যার যার বাড়ি যাও, কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই কুয়াকাটা ও কক্সবাজার ঘুরতে বেরিয়ে পড়।

 উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখি তারা এতোটাই সচেতন যে সরকার বলার আগেই তারা নিজেরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে। এদিকে আমরা কি করি, সরকার আমাদের কানের কাছে মাইক বাজিয়ে মাইকিং করলেও সেটা না শুনে নিজেরা ভুল করি আর দোষ দেই সরকারের। আমরা এমন এক জাতি যে জাতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে শুধু বাধাই প্রয়োগ করেই ক্ষান্ত হই না, বরং বাংলাদেশ কে আরো পিছিয়ে রাখা যায় কিভাবে জেনে বুঝে সেটা নিশ্চিত করি।

 যে জাতি নিজের ভালো বোঝে না সে জাতির উন্নয়ন স্বয়ং বিধাতাও করতে চায় না। এই যে এত এত নিষেধাজ্ঞার পরও যখন হাজারো জনতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জানাজায় শরিক হলেন তখনও প্রধানমন্ত্রীর দোষ ছিল? সরকারী নির্দেশনাবলী অমান্য করে যারা ঘরের বাইরে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছেন তার জন্যও বলব সরকারের দোষ! আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রী কি প্রত্যেক কে কোলে করে ঘরে রেখে আসবেন তারপর কি তারা ঘরবন্দী হবে বলে ঠিক করেছেন, এর আগে নয়?

সারা বাংলাদেশে এখন চলছে চুরির মহাযজ্ঞ। বিভিন্ন জেলা, উপজেলার চেয়ারম্যান, ছাএলীগ নেতারা ত্রাণের চাল, চুরি করছে, দোষ হয় সরকারের। আচ্ছা, গরীবের হক আত্মসাত করা যে কতবড় অন্যায় এটা কি ভদ্রবেশী চোরেরা জানে না। আসলে আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো, আমরা এক হাতে ঘুষ খাই, চুরি করি আর অন্য হাতে টুপি নিয়ে মসজিদে দৌড়াই। এই হলো আমাদের সততা। আমরা মরব তবু লোভ সংবরণ করতে পারব না।

 জাতি হিসেবে আমরা যে অশিক্ষিত জাতি সেটাও কিন্তু নয়। উন্নত অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষিতের হার অনেক বেশি। তবু কেন আমাদের এই মানষিক বিপর্যয়? আমারা আসলে ইংরেজি, অর্থনীতি, রাজনীতি পড়তে পড়তে নৈতিকতার মূলনীতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারি নাই। কি করে পরিচিত হব, মানবিকতা-নৈতিকতার সঙ্গে না পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমাদের বাবা-মা, না আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সবাই চেয়েছে আমরা উপরে উঠি, উপরে উঠার সর্বোচ্চ সিঁড়িতে আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উঠছি নাকি বৈদ্যুতিক লিফটের সাহায্যে উঠছি তা দেখার কেউ প্রয়োজন মনে করে না। উপরে উঠেছি এতেই মহাখুশি।

লেখক
লেখক

সব কিছুরই একটা শেষ আছে। বাঙালী জাতির এই দুরবস্থারও একটা যথাযথ হ্যস্ত-ন্যস্ত হওয়া উচিত। দেশনেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এখনই উচিত তার নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা। এতে করে আমরা যদি একটু পাপ-পূর্ণের বিচার করতে শিখি। তা না হলে, বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় আমরা কখনোই কেউ কাউকে দ্বিতীয় হওয়ার সুযোগ দেব না, একযোগে সবাই প্রথম হয়ে বসে থাকব। আর যাই হোক, এভাবে একটা রাষ্ট্র কখনোই সামনে এগুতে পারবে না, এখন যেমন আছে ৫০ বছর পরেও ঠিক তেমনই থাকবে। তার চেয়ে বড় কথা আমরা যেহেতু, পাহাড়সম পাপের চূড়ায় দাড়িয়ে নিচু স্তরের মানুষগুলোকে পোকামাকড় ভাবি। তাই, পোকামাকড়ের খাওয়া, না খাওয়া বা বাঁচা, না বাঁচায় আমাদের কিছু আসে যায় না। সে জন্যই হয়তো, করোনার কঠিন ছোবলেও আমরা পাপ পূর্ণের হিসেব না করে নিরীহ, অসহায় মানুষের মুখের খাবার চুরি করতে পিছপা হই না। এ কারনেই কি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অতীব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলেছিলেন,

'দেশ স্বাধীন করে সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে চোর, বাঁয়ে চোর, সামনে চোর, পিছনে চোর, চোর আর চোর।

জাতির পিতার দুঃখ ভুলাতে আমরা কি পারি না চোর মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে।

আমি না হয় সেদিনের আশায় দিন গুনতে থাকি। এমনওতো হতে পারে, সেদিন বেশি দূরে নয়।