বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা ব্যয় সাড়ে ৪ লাখ, সরকারিতে ৩৬ হাজার
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে গড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালে এই ব্যয়ের পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ একজন করোনা রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় সাড়ে ১২ গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে সেবা গ্রহণের এ ব্যয় রোগীর জন্য অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়ার খরচের মধ্যে শয্যা, ওষুধ, আইসিইউ, অক্সিজেন ও অন্যান্য খরচ রয়েছে।
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় ২২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন। তাঁদের মধ্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ পাননি প্রায় ৬৫ শতাংশ। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাননি ৩৩ শতাংশের বেশি রোগী। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর থেকে শয্যা পেতে সেবাগ্রহীতাদের গড়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে প্রায় ১৫ শতাংশ রোগীর অক্সিজেন পেতে দেরি হয়েছে।
সরকারি হাসপাতাল থেকে কোভিড-১৯ সেবা নিতে ১২ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে ৪০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে সেবার অপ্রতুলতার কারণে ভালো সেবা পেতে সাড়ে ২৬ শতাংশ সেবাগ্রহীতা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা নিয়েছেন বলে গবেষণায় দেখা গেছে। যাঁরা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা নিয়েছেন, তাঁরা এর পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মান ভালো, বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া, আইসিইউ শয্যা পাওয়া এবং সরকারি হাসপাতালে শয্যা খালি না পাওয়া উল্লেখযোগ্য।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দুই বছর পার হলেও প্রয়োজনের তুলনায় পরীক্ষাগার স্বল্পতা, পরীক্ষাগারে সক্ষমতার চেয়ে সেবাগ্রহীতা বেশি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে করোনার নমুনা পরীক্ষায় এখনো সমস্যা রয়েছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২৬ শতাংশকে করোনার নমুনা দিতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬৯ শতাংশ বলেছেন, নমুনা দেওয়ার সময় পরীক্ষাগারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়নি। করোনার নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে গড়ে আড়াই দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
নমুনা পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে যাতায়াত বাবদ গড়ে ১৪০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। যাঁরা সরকারি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করিয়েছেন, তাঁদের যাতায়াত, পরীক্ষা ফি ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে গড়ে ৩৯৯ টাকা খরচ করতে হয়েছে। আর বেসরকারি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে গড়ে ৩ হাজার ৩৮১ টাকা খরচ হয়েছে।
বর্তমানে আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৬১ শতাংশ ঢাকা শহরে অবস্থিত এবং মোট আইসিইউ শয্যার ৩৭ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালে। ৩১টি জেলা হাসপাতালে এখনো আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়নি। নিজ জেলায় আইসিইউ সুবিধা না থাকায় কোভিডে আক্রান্ত জটিল রোগীদের ভিন্ন জেলায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। জরিপে দেখা যায়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে সেবা নেওয়া রোগীদের প্রায় ১৯ শতাংশ অন্য জেলায় চিকিৎসা নিয়েছেন, যা তাঁদের ওপর অতিরিক্ত খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঘাটতি
করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা কর্মসূচি নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন ১০টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ প্যাকেজগুলোর অধীন দুই ধাপে মোট ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই প্যাকেজগুলোর আওতায় গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ২১৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২৫-৩০ শতাংশ উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। মোট শিল্প খাতের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হলেও এ খাতের জন্য বরাদ্দ প্রণোদনা পর্যাপ্ত নয়। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এ খাত নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের প্রণোদনা কর্মসূচির ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ উদ্যোক্তা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া এই খাতের সাড়ে ৩৬ শতাংশ উদ্যোক্তা প্রণোদনা ঋণের জন্য আবেদন করেছেন। মাত্র ১১ শতাংশ এ প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। ঋণ না পাওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কারও তদবির বা সুপারিশ না থাকা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ব্যাংক জামানত না থাকা, ব্যাংক কর্মকর্তাদের কমিশন না দেওয়ায় অসহযোগিতা এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মোটাদাগে করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকারের ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে সুশাসনের আঙ্গিকে দেখলে প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। টিকার পেছনে কত অর্থ ব্যয় হয়েছে, সেটির সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। গোপনীয়তার সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে। সাধারণত পেছনের কোনো দুর্নীতি ঢাকতে তথ্য প্রকাশ করা হয় না, এটি উদ্বেগজনক।