মুন্সিগঞ্জে সংক্রমণ কেন কমছে না, বুঝতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ

এক মাস ধরে দেশের প্রায় সব জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমছে। কিন্তু বিপরীত চিত্র মুন্সিগঞ্জে। এই জেলায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার উদ্বেগজনক। গত এক সপ্তাহে (২৩ থেকে ২৯ আগস্ট) সারা দেশে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে মুন্সিগঞ্জে রোগী শনাক্তের হার ৪০ শতাংশের বেশি।

মুন্সিগঞ্জে কেন সংক্রমণ কমছে না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছে না স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। এমনকি এই জেলায় সংক্রমণ কমাতে তাদের বাড়তি কোনো উদ্যোগও নেই।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মুন্সিগঞ্জের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো পুরো জেলায় যেভাবে লকডাউন (অবরুদ্ধ) দেওয়া হয়েছিল, সে রকম কোনো ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে নেওয়া যেতে পারে। অথবা দেশে সংক্রমণের শুরুর দিকে রাজধানীর টোলারবাগ বা পূর্ব রাজাবাজারে যেভাবে ছোট ছোট এলাকায় চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সে রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। দেখতে হবে জেলার কোন কোন জায়গায় ক্লাস্টার (কাছাকাছি জায়গায় অনেক রোগী) তৈরি হয়েছে। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে ক্লাস্টারগুলো দ্রুত ভেঙে দিতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মনে হচ্ছে মুন্সিগঞ্জে ক্লাস্টার আছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্লাস্টার চিহ্নিত করে আইইডিসিআর, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, স্থানীয় প্রশাসন সবাই মিলে কাজ করতে হবে। হয়তো বিধিনিষেধের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু শনাক্ত ব্যক্তিদের সবাইকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন রাখা) নিতে হবে। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) রাখতে হবে।

মুন্সিগঞ্জ ছাড়াও দেশের আরও ছয়টি জেলায় গত এক সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এর মধ্যে চারটি জেলাই ঢাকা বিভাগে। এগুলো হলো মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও শরীয়তপুর। অবশ্য দেশে সংক্রমণের শুরু থেকেই ঢাকা বিভাগে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি। এখনো সে প্রবণতা অব্যাহত আছে।

শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি থাকা অন্য তিনটি জেলা হলো ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও ভোলা। শনাক্তের হার এখনো ২০ শতাংশের বেশি, এমন সাত জেলার সব কটিতেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে মুন্সিগঞ্জ জেলায় মোট ২ হাজার ৮৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৮৪০ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই এক সপ্তাহে মোট পরীক্ষার বিপরীতে এখানে রোগী শনাক্তের হার ৪০ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৫ জন। আর গতকাল পর্যন্ত এই জেলার সরকারি জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন ২৪ জন।

মুন্সিগঞ্জের সিভিল সার্জন আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কী কারণে আক্রান্তের হার এত বেশি, তা বলা যাচ্ছে না। তবে জেলায় মৃত্যুর হার অন্য জেলার তুলনায় কম।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্তের খবর জানানো হয়। আর চলতি বছরের মার্চ থেকে শুরু হয় সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যায়। গত জুন মাস থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডেলটা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে নতুন রোগী বাড়তে শুরু করে। জুনের শেষ দিকে মৃত্যু আরও বাড়তে থাকে। জুলাই মাসে এসে পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পর চলতি আগস্টের শুরু থেকে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার কমতে শুরু করে। ১১ আগস্ট থেকে প্রায় সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়।

সংক্রমণ না কমলেও সারা দেশের মতো মুন্সিগঞ্জেও এখন কোনো বিধিনিষেধ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা ছাড়া সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি থাকছে উপেক্ষিত। এই জেলার মধ্যে সদর উপজেলায় সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। লোকসমাগমও বেশি হয় এখানে। বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান। সেখানে অনেক মানুষের জমায়েত হচ্ছে, যা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত এখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাড়তি বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি কাজী নাহিদ রাসুল প্রথম আলোকে বলেন, করোনা শুরু থেকে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রতিটি পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, গ্রাম-পাড়া-মহল্লা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সংক্রমণ রোধে ব্যক্তিসচেতনতা বেশি প্রয়োজন। সবাইকে নিজ ও পরিবারের কথা ভেবে ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

মৃত্যু ২৬ হাজার ছাড়াল

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় সংক্রমিত হয়ে আরও ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশে করোনায় মোট মৃত্যু ২৬ হাজার ছাড়াল (২৬ হাজার ১৫ জন)। এর মধ্যে সর্বশেষ ১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে গত ৯ দিনে।

গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭ হাজার ৯২১ জনের নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৯৪৮ জন। এ নিয়ে মোট ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। গতকাল পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। গতকাল নিয়ে টানা দুই দিন রোগী শনাক্তের হার সামান্য বেড়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার পর সবখানেই আগের মতো ভিড় জমছে। স্বাস্থ্যবিধিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে যেকোনো সময় সংক্রমণ পরিস্থিতির আবার অবনতি হতে পারে।