রাজশাহীর সঙ্গে খুলনার পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে

দেড় মাসের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে গতকাল।

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতির বড় অবনতি হয়েছে। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই ভারত-সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছিল। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে থাকে। এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতেও সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকার আশপাশেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণের আরেকটি ঢেউ দেশে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

গত এক সপ্তাহে (১৩ থেকে ১৯ জুন) করোনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৬ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে গড়ে প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ জনের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর আগের সপ্তাহে (৬-১২ জুন) প্রতিদিন গড়ে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ১৬৭ জন। আর মৃত্যু হয়েছিল গড়ে ৩৮ জনের।

দেশে সংক্রমণের শুরু থেকে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে এবং চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের জেলাগুলোতে সংক্রমণ বেশি ছিল। তখন বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি। এবার বিশেষত ঈদুল ফিতরের পর থেকে সংক্রমণ বেশি বাড়ছে উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। গ্রামেও সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু পদক্ষেপে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আশপাশে সংক্রমণ বাড়ছে। গত কয়েক দিনের চিত্র বলছে, এখন উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে খুলনা বিভাগেও।

গত এক সপ্তাহে (১৩ থেকে ১৯ জুন) দেশে করোনায় আক্রান্ত মোট ৩৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক সপ্তাহে মোট মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশই হয়েছে খুলনা বিভাগে। তিন দিন ধরে এই বিভাগে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারও অন্য যেকোনো বিভাগের চেয়ে বেশি। তিন দিন ধরে এখানে রোগী শনাক্তের হার ৩৪ শতাংশের ওপরে।

খুলনার পর গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এক সপ্তাহে মোট মৃত্যুর ২১ দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে এই বিভাগে। এর আগে বেশি মৃত্যু দেখা যেত ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে।

খুলনা বিভাগের প্রায় সব জেলায়ই সংক্রমণ বাড়ছে। এর মধ্যে খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গায় সংক্রমণ বেশি। খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) ফেরদৌসী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহখানেক ধরে শনাক্তের হার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে না মানলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।

সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এই বিভাগের করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ১৩০ শয্যার একমাত্র হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই হাসপাতালে শয্যাসংখ্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি থাকছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে খুলনা জেনারেল (সদর) হাসপাতালকে ৭০ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। তবে ওই হাসপাতাল থেকেই অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও কোনো আইসিইউ নেই। আজ রোববার আইসিইউ চালু হতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মঙ্গলবার থেকে জেলায় লকডাউন কঠোরভাবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

খুলনার জেলা প্রশাসক ও খুলনা জেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, কঠোর লকডাউন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য শিগগির গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সবাইকে জানানো হবে। একই সঙ্গে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা, স্বাস্থ্যবিধি পালনে মনিটরিং জোরদার করা ও প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। আর চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এখনো কিছু বিধিনিষেধ জারি আছে। লকডাউনের প্রভাবে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছিল। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করেছিল, জুনে পরিস্থিতি খারাপ হবে। সে আশঙ্কা এখন সত্যি হতে চলেছে।

ঈদের পর দেশে সংক্রমণের ৬৩তম সপ্তাহ (১৬ থেকে ২২ মে) থেকে নতুন রোগী ক্রমে বাড়তে শুরু করে। মৃত্যু বাড়তে শুরু করে ৬৫তম সপ্তাহ (৩০ মে-৫ জুন) থেকে। এত দিন প্রতি সপ্তাহে নতুন শনাক্ত ও মৃত্যু বৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতি দ্রুতই খারাপ হচ্ছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় গতকাল শনিবার শেষ হওয়া সংক্রমণের ৬৭তম সপ্তাহে (১৩-১৯ জুন) নতুন রোগী বেড়েছে ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। এই সময়ে মৃত্যু বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।

বিভাগওয়ারি হিসাবে রাজশাহী বিভাগে তিন দিন ধরে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে আছে। তবে উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগে এই সময়ে রোগী শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ঘরে। অবশ্য এখানে পরীক্ষা ও রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। সারা দেশ বিবেচনায় নিলে দুদিন ধরে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৮ শতাংশের ওপরে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে মোট ১৬ হাজার ৯৬৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত দেড় মাসের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যু। গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ৮ লাখ ৪৮ হাজার ২৭ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৮০ হাজার ১৪৬ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ৪৬৬ জনের।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় সব জেলাতেই আবার সংক্রমণ বাড়ছে। ঢাকার আশপাশে ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জে সংক্রমণ ক্রমবর্ধমান। সংক্রমণ আরেকটি ঢেউয়ের আকার ধারণ করছে। যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে আবার যাতায়াতের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, খুলনা ও রাজশাহী)