রাশিয়ার টিকার সরবরাহ চুক্তির শর্ত নিয়ে আপত্তি

রাশিয়ার তৈরি করোনার টিকা স্পুতনিক-ভি
ছবি: রয়টার্স।

রাশিয়ার কাছ থেকে ‘স্পুতনিক-ভি’ টিকা আনার জন্য সে দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আরডিআইএফ যে সরবরাহ চুক্তি তৈরি করেছে, তার বেশ কিছু শর্ত বা ধারা নিয়ে আপত্তি রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় বলছে, আরডিআইএফ যে সরবরাহ চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে, তা মেনে নিলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৮ পাতার এই চুক্তিপত্র আইন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সরবরাহ চুক্তিপত্রের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে আটটি ধারা ও উপধারা নিয়ে তারা আপত্তি করেছেন। এ ছাড়া টিকার দামও অনেক বেশি, যা নিয়ে দর-কষাকষি করা উচিত বলে মনে করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

যেখানে আপত্তি : # উৎপাদনের হার কমে গেলে ও কাঁচামালের ঘাটতির জন্য সরবরাহ বিলম্ব হলে বিক্রেতা দায়ী থাকবে না। # সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টিকা সরবরাহ করতে বিলম্ব হলেও তা গ্রহণ করতে হবে। # টিকার অকার্যকারিতা বা কম কার্যকারিতার জন্য বিক্রেতার দায়দায়িত্ব কম।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, টিকা সরবরাহের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আরডিআইএফ বাংলাদেশকে ১৮ পাতার একটি সরবরাহ চুক্তিপত্র পাঠিয়েছে।

এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও রাশিয়ার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অব রাশিয়া ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (আরডিআইএফ) মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল গোপনীয়তার চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ তৃতীয় পক্ষের কাছে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করতে পারবে না। গোপন তথ্য হিসেবে ক্লিনিক্যাল ডেটা ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত এবং চুক্তির বিষয়বস্তুকে উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তির অনুলিপি মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের হাতে দেওয়া হয়।

চুক্তির যেসব ধারায় আপত্তি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরবরাহ চুক্তির ২.৪ উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কম্পোনেন্ট-১’ ও ‘কম্পোনেন্ট-২’ আলাদা পাঠাবে। এ দুটো কম্পোনেন্ট দিয়ে দুই ডোজ বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এদের স্পেসিফিকেশন আলাদা কি না, তা স্পষ্টীকরণ করা হয়নি। এ ছাড়া চুক্তিতে বলা হয়েছে, উৎপাদনের হার কমে গেলে ও কাঁচামালের ঘাটতির জন্য সরবরাহ বিলম্ব হলে বিক্রেতা দায়ী থাকবে না। বরং সরবরাহের সময় বাড়ানো হবে যত দিন না পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়।

চুক্তির ২.৭ উপধারায় উল্লেখ রয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া টিকার পরিমাণ আবশ্যিকভাবে ক্রয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে টিকা সরবরাহ করতে বিলম্ব হলেও তা গ্রহণ করতে হবে।

২.৮ উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম চালানের আগে মোট ক্রয়মূল্যের ৫০ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে প্রতিকারের কী ব্যবস্থা হবে, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।

৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে, টিকা ব্যবহারের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বিক্রেতাদের সরবরাহ করতে হবে। অথচ এই ধারাতেই বলা হয়েছে, সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দায় ক্রেতার। এ ক্ষেত্রে যদি তারা দায়দায়িত্ব গ্রহণ না করে, তাহলে রোগীর রোগসংক্রান্ত তথ্য তাদের কেন জানানো হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

৬ নম্বর ধারায় ‘দায়’ সেকশনে বলা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই টিকার অকার্যকারিতা বা কম কার্যকারিতার জন্য বিক্রেতার দায়দায়িত্ব সর্বোচ্চ ১ লাখ ডলার বা মোট ক্রয়মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি হবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশ্ন, এটা কোন হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে? যেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের টাকা পরিশোধ করা হবে, সেখানে সর্বোচ্চ দায় নির্দিষ্ট করা যৌক্তিক কি না? আবার এই ধারাতেই বলা আছে, পণ্য দক্ষতার দায় বিক্রেতার নয়, তাহলে সেই দায়দায়িত্ব কার?

৯ ধারার ইনডেমনিটি বা ক্ষতিপূরণ চুক্তিভঙ্গের সব দায় থেকে বিক্রেতা কিংবা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়মুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তি ভঙ্গ করা হলেও তাদের কিছু করা যাবে না।

১০.৩ উপধারায় বেশ কিছু পরিস্থিতিতে বিক্রেতাকে চুক্তি সমাপ্ত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রেতার জন্য অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এ ক্ষেত্রে একবার চুক্তি হয়ে গেলে তারা যা-ই করুক না কেন, বাংলাদেশের চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ নেই।

খসড়ার ১.২ উপধারায় ক্রেতা তথা সরকারকে ‘নন এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ বলা হয়েছে। তার মানে বিক্রেতা চাইলে অন্যদের কাছেও বিক্রি করতে পারবে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ মনে করে, এটা ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ হওয়া উচিত।

চুক্তির কিছু ধারায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়য়ের আপত্তির প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান গতকাল শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। তবে সরকারি-বেসরকারি এ ধরনের সব চুক্তির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্য থাকা সংগত।

আগের অবস্থা

এর আগে ২ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন একটি চিঠি দেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে দেওয়া চিঠিতে তিনি জানান, চুক্তি সই ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে রাশিয়া থেকে করোনাপ্রতিরোধী ‘স্পুতনিক-ভি’ টিকা আনতে অন্তত এক মাস লেগে যেতে পারে।

দ্রুত চুক্তিতে সই করার অনুরোধ জানিয়ে দেওয়া চিঠিতে টিকা আনার ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপের কথা উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রসচিব। পররাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারকে টিকার (রাশিয়ার) প্রস্তুত করা প্রথম চালানের মূল্য আগে পরিশোধ করতে হবে। অগ্রিম মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে এবং নমুনা অনুমোদন হওয়ার পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে টিকার প্রথম চালান বাংলাদেশে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

প্রতি চালানে বা ফ্লাইটে এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ টিকা বহন করা সম্ভব হবে বলে রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আরডিআইএফ জানিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার সম্মতিতে চূড়ান্ত সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়াতে পাঠাতে হবে। সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আরডিআইএফ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে তাদের উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় টিকার ডোজ উৎপাদনের নির্দেশনা দেবে।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমরা ব্যবস্থা করে দিয়েছি, এখন এটা ফসকে যাবে যদি দ্রুত চুক্তি না হয়।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের বলছে, রাশিয়া একতরফা প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বলছে, সময়মতো দিতে না পারলে তার কোনো জরিমানা নেই। না দিতে পারলে তাদের ওপর বাধা নেই। তারা তাদের লাইনে কথা বলেছে। এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ঠিক করে বলতে হবে কোন কোন ক্ষেত্রে আলোচনা লাগবে। এরপর আমরা সেটা রাশিয়াকে জানাব। আলোচনার পরই চূড়ান্ত ডকুমেন্ট তৈরি হবে।’ তিনি বলেন, ‘টিকার দাম আমাদের কাছে বেশি বলে মনে হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক, টিকা কিনতে হলে অগ্রিম টাকা দিতে হবে। এরপর তারা উৎপাদন করবে।’

এর আগে ২৭ এপ্রিল দেশে রাশিয়ার টিকা স্পুতনিক-ভি-এর জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত জরুরি জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ওষুধ, পরীক্ষামূলক ওষুধ, টিকা ও মেডিকেল সরঞ্জামবিষয়ক কমিটি এই অনুমোদন দেয়। এখন রাশিয়ার এই টিকা আমদানি ও ব্যবহারে আইনগত বাধা নেই।

করোনার টিকা নিয়ে গঠিত কোর কমিটি রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি সংগ্রহের জন্য সুপারিশ করেছে। স্পুতনিক-ভি টিকার কার্যকারিতা ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ উল্লেখ করে কোর কমিটি বলেছে, এটি রাশিয়ার ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত। বিশ্বের ৬১টি দেশে এ টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। দাম প্রতি ডোজ ১০ থেকে ২০ ডলার।