ঢাকার বাইরে হাসপাতালে রোগীর চাপ, আইসিইউ–সংকট

ঈদের ছুটিতে গিয়ে গ্রামে রয়ে গেছে বিপুল মানুষ। জেলা হাসপাতালগুলো নানা সংকটে জর্জরিত। সেখানে চাপ আরও বাড়ছে।

শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় করোনা আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কঠোর বিধিনিষেধে যানবাহন না পেয়ে স্বজনেরা ভ্যানে করে তাঁকে হাসপাতালে আনেন। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় বরিশাল নগরে।ছবি: সাইয়ান

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় করোনার সংক্রমণ আগে থেকেই বাড়ছিল। এর মধ্যে ঈদুল আজহার ছুটিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে গেছে। ফলে জেলায় জেলায় করোনা রোগী আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

উদ্বেগের দিক হলো, জেলা হাসপাতালগুলো নানা সংকটে জর্জরিত। অনেক হাসপাতালেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। কোনো কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে, তবে তা খালি পাওয়া দুষ্কর। উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থারও ঘাটতি আছে। কোনো কোনো হাসপাতালে এখন রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। চিকিৎসকসহ জনবলের ঘাটতি পূরণের উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।

এ অবস্থায় ঢাকার বাইরে সংক্রমণ আরও বাড়লে জেলা হাসপাতালে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদেরা যেমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তেমনি উদ্বিগ্ন মাঠপর্যায়ের চিকিৎসকেরাও।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ও করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী এক সপ্তাহে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না। এখনই রোগীদের শয্যা দিতে পারছি না।’ তিনি বলেন, এই হাসপাতালে আরও চিকিৎসক দরকার। তিনজন চিকিৎসক এক পালায় ৩০০ রোগীর কীভাবে সেবা দিতে পারেন। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শের-ই বাংলা মেডিকেলে সাময়িকভাবে চিকিৎসক পাঠানোর পরামর্শ দেন।

যেসব জেলায় নতুন করে রোগী দ্রুত বাড়ছে তার একটি বরিশাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বরিশাল জেলায় গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৬২ জনের করোনা পরীক্ষা হয়। শনাক্ত হয়েছেন ৭৬ জন। শনাক্তের হার প্রায় ৪৭ শতাংশ। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা আছে ২৭৮টি। সব কটিতেই রোগী ভর্তি ছিল। ২২টি আইসিইউ শয্যার সব কটিই পূর্ণ ছিল।

গতকাল হাসপাতালটিতে দুপুর পর্যন্ত অন্তত ২০ জন রোগী ভর্তির জন্য যান। তাঁদের মেঝেতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আমার বাবার অবস্থা খুব খারাপ। আইসিইউতে শয্যার জন্য দুই দিন ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু খালি নেই।’ তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে বাবার অসহ্য যন্ত্রণা দেখছি। কিন্তু কিছু করার নেই। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে।’

বরিশাল ছাড়াও চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর ও নরসিংদীর জেলা হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইসিইউ শয্যার সংকট প্রকট। পাশাপাশি কোথাও কোথাও সাধারণ শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। কোথাও অল্প কিছু শয্যা খালি আছে। চিকিৎসকেরা আগামী কয়েক সপ্তাহের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, জেলা পর্যায়ে মানুষের সংখ্যা এখন আগের তুলনায় বেশি। এবার ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে যাওয়া মানুষেরা বেশির ভাগই ফিরতে পারেননি অথবা ফেরেননি। মোবাইল অপারেটরদের তথ্য ধরে বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা থেকে যাওয়া ৫২ লাখ মানুষ গ্রামে রয়ে গেছেন।

দেশে গত মার্চে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। তখন ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলায় করোনা পরিস্থিতির অবনতি হয়। সেই প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর এখন পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ।

ঢাকার কাছের জেলা নরসিংদীতে করোনার জন্য নিবেদিত একমাত্র ৮০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতাল এখন রোগীতে পূর্ণ। গতকালই সেখানে প্রথমবারের মতো সব শয্যা পূর্ণ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে করোনায় আক্রান্ত ৭১ জন এবং উপসর্গ নিয়ে ২৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, জেলায় গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২০৬টি নমুনার বিপরীতে ৬০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার প্রায় ২৯ শতাংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নরসিংদী জেলায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ নেই। শুধু জেলা হাসপাতালে পাঁচটি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলা রয়েছে। যদিও কার্যকর রয়েছে দুটি। অক্সিজেন বেশি লাগে বলে এ দুটিও আপাতত ব্যবহার করা হচ্ছে না।

হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) এ এন এম মিজানুর রহমান বলেন, যে হারে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বর্তমান জনবল দিয়ে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

কুষ্টিয়ায় পরিস্থিতি আগে থেকেই খারাপ ছিল। সেখানকার জেলা হাসপাতালে গতকাল ২০০ শয্যার বিপরীতে করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন ১৮৬ জন। এ ছাড়া উপসর্গ নিয়ে ভর্তি ছিলেন ৬০ জন। কিছু রোগী শয্যা না পেয়ে দোতলার মেঝেতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় এই হাসপাতালে ১৪ জন রোগী মারা যান। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগী ১৩ জন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। সেখানে আইসিইউর শয্যা খালি পাওয়া কঠিন। দিনাজপুর ও রংপুর জেলা হাসপাতালেও পরিস্থিতি একই, আইসিইউর শয্যা খালি পাওয়া যায় না। খুলনায়ও আইসিইউ শয্যার সংকট কাটেনি। তবে সাধারণ শয্যা এখন খালি আছে।

চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফলে হাসপাতালে খালি শয্যা থাকছে না। আইসিইউ শয্যার সংকট আগে থেকে ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গতকাল চট্টগ্রাম মহানগরের চারটি সরকারি করোনা হাসপাতালে ৫৩৯টি শয্যার মধ্যে খালি ছিল ৯৮টি।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, শয্যা খালি নেই। গতকাল দুপুরে অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর একটি শয্যা খালি হলে সিটি করপোরেশনের ঈশান নামের এক কর্মীকে ভর্তি করা হয়। তাঁকে দ্রুত আইসিইউ শয্যায় স্থানান্তর করা প্রয়োজন বলে চিকিৎসক লিখে দেন। কিন্তু আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ভর্তি করা যায়নি।

জেনারেল হাসপাতালের কোভিড চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মুখপাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মো. আবদুর রব বলেন, ‘শুধু ঈশান নয়, আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছয়-সাতজনের আইসিইউ শয্যা দরকার। এ ছাড়া বাইরের অনুরোধ আছে। কিন্তু কিছু করার নেই। কোথায় পাব এত আইসিইউ শয্যা।’

রোগীর চাপ বেড়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও (চমেক)। গতকাল সেখানে রোগী ছিলেন ২৮৬ জন। শয্যা সংকুলান না হওয়ায় রোগী মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, রোগী দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। অবস্থা খারাপ হওয়া রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধি ও প্রতিবেদকেরা]