রোগী দ্রুত বাড়ছে চট্টগ্রাম বরিশাল ও সিলেটে

এই তিন বিভাগে রোগী বাড়ার হার ও পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত তুলনামূলক বেশি। ঢাকায় মৃত্যু বাড়ছে।

রাজশাহী ও খুলনার পর এবার চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এই তিন বিভাগে রোগী বাড়ার হার ও পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত তুলনামূলক বেশি। তবে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো বেশি ঢাকা ও খুলনা বিভাগে।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর ১৬ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে খারাপ। সার্বিকভাবে রোগী ও মৃত্যু বাড়ছেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেওয়া দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ গতকাল বুধবার শেষ হয়েছে। তবে বিধিনিষেধের ইতিবাচক কোনো প্রভাব এখনো দেখা যাচ্ছে না।

এরই মধ্যে পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। আট দিনের জন্য প্রায় সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে আজ বৃহস্পতিবার দোকানপাট ও বিপণিবিতান খুলবে। সারা দেশে চলবে গণপরিবহন।

ফলে ঈদের পর সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন গ্রামে সংক্রমণ বেশি। সামনে গ্রাম ও শহর—দুই জায়গাতেই সংক্রমণ আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। ইতিমধ্যে দেশে করোনায় মৃত মানুষের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়েছে। ২০০ জনের বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে টানা চার দিন ধরে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন গতকাল বুধবার অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলেন, এখন বরিশাল ও চট্টগ্রামে সংক্রমণের হার অনেক বেশি। সামনে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিধিনিষেধ শিথিলের পর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। শুরু থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু

বেশি ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে। গত জুন থেকে ডেলটা ধরন (ভারতে উৎপত্তি) ছড়াতে শুরু করলে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে। রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। সর্বশেষ রাজশাহীর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে খুলনা এখনো ভুগছে।

মৃত্যু বেশি ঢাকা ও খুলনায়

মহামারির শুরু থেকেই মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল রাজধানী ঢাকা ও ঢাকা বিভাগে। মাঝখানে মৃত্যুতে ঢাকাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল খুলনা বিভাগ। এখন আবার ঢাকায় মৃত্যু বেড়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে (৮-১৪ জুলাই) সবচেয়ে বেশি ৪৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে। চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের তুলনায় গতকাল শেষ হওয়া দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় মৃত্যু বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গতকাল বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৬৯ জন মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে। জেলাওয়ারি হিসাবে সর্বোচ্চ ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ)। বেশ কিছুদিন ধরে এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকায় যেসব মৃত্যু হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রোগীদের একটি অংশ অন্য জেলা থেকে আসা। তাঁরা উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে এসেছিলেন। সব মিলিয়ে ঢাকায় মৃত্যু বেশি।

ঢাকার পর গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি ৪০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। তবে আগের সপ্তাহের তুলনায় খুলনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ার হার তুলনামূলক কম, ২০ শতাংশ। মৃত্যুর দিক দিয়ে গত সপ্তাহে তৃতীয় অবস্থানে ছিল চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে মারা গেছেন ২২৮ জন। তবে সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি এই বিভাগে, ৭৮ শতাংশ।

রংপুরেও মৃত্যু বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে এ বিভাগে করোনায় ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংখ্যার দিক থেকে কম হলেও এক সপ্তাহে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে মৃত্যু বাড়ার হার বেশি, ৪৫ শতাংশের ওপরে।

সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো বিপজ্জনক মাত্রায় আছে। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় সারা দেশেই যাতায়াত ও লোকসমাগম বাড়বে। ফলে ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
মুশতাক হোসেন, উপদেষ্টা, আইইডিসিআর

তিন বিভাগে সংক্রমণ বাড়ছে

দেশের প্রায় সব জেলায়ই করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। ৯ দিন ধরে দৈনিক ১১ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। রোগী শনাক্তের হারও টানা ৩১ শতাংশের বেশি ছিল। তবে দুদিন ধরে রোগী শনাক্তের হার কিছুটা কমে ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে।

বিভাগওয়ারি হিসাবে দেখা যায়, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রামে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। তিন দিন ধরে বরিশাল বিভাগে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৪০ শতাংশের ওপরে। সিলেটেও হারটি ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। চট্টগ্রাম বিভাগে রোগী শনাক্তের হার ৩৪ শতাংশের বেশি। খুলনায়ও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। সেখানে তিন দিন ধরে শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ঘরে। ঢাকায় এই হার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।

চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহের সংক্রমণ চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম সপ্তাহের (১-৭ জুলাই) তুলনায় দ্বিতীয় সপ্তাহে (৮-১৪ জুলাই) রোগী বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি ছিল চট্টগ্রামে। এই বিভাগে এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন রোগী বেড়েছে প্রায় ৭২ শতাংশ। চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৩ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই প্রথম চট্টগ্রামে এক দিনে করোনা শনাক্ত হাজার ছাড়াল।

চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে শনাক্তের হার তিন দিন ধরে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে বরিশালের সব জেলায়ই রোগী শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ওপরে।

বরিশাল বিভাগে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীর চেয়ে উপসর্গে মৃত্যু বাড়ছে। মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত বরিশালে করোনা শনাক্ত রোগী মারা গেছেন ৩৬৫ জন। আর উপসর্গ নিয়ে কেবল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে মারা গেছেন ৬৩৪ জন।

‘ঈদের পর সংক্রমণ বাড়বে’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১২ হাজার ৩৮৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২১০ জনের। গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৮ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তাঁদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৯৭ হাজার ৪১২ জন, আর মারা গেছেন ১৭ হাজার ৫২ জন।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো বিপজ্জনক মাত্রায় আছে। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় সারা দেশেই যাতায়াত ও লোকসমাগম বাড়বে। ফলে ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, এবার গ্রামে সংক্রমণ বেশি হয়েছে। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর বড় শহরগুলোতে সমাগম বাড়বে। আবার ঈদে দেশের মানুষের একটি বড় অংশ গ্রামে যাবেন, আবার তাঁরা শহরে ফিরবেন। সব মিলিয়ে গ্রামের পাশাপাশি শহরেও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

সামাজিক অনুষ্ঠান করা যাবে না

এক তথ্য বিবরণীতে গতকাল সরকার জানিয়েছে, বিধিনিষেধে আট দিনের যে শিথিলতা এসেছে, তার মধ্যে সব পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্রে যাওয়া যাবে না। জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও পরিহার করতে হবে।

ঈদের পর ২৩ জুলাই সকাল ছয়টা থেকে আগামী ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত আবারও কঠোর বিধিনিষেধ থাকবে। তখন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সব শিল্পকারখানাও বন্ধ থাকবে।