‘লকডাউন’ ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ

প্রতীকী ছবি

জয়পুরহাটের সদর ও পাঁচবিবি পৌরসভায় করোনা নিয়ন্ত্রণে ৭ জুন থেকে বিধিনিষেধ চলছে। তবে এ সময় এই দুই পৌরসভায় করোনা শনাক্তে পরীক্ষা বাড়েনি। রোগীদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের চিহ্নিত করার (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং) কাজও জোরদার করা হয়নি। বিধিনিষেধের ফলে আয় হারানো মানুষ সহায়তাও পায়নি।

অথচ ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হলে তা সফল করা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কী কী করতে হবে, তা সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি আগেই ঠিক করে দিয়েছে। গত বছরের জুনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আট বিশেষজ্ঞ মিলে এ বিষয়ে একটি কৌশলপত্র তৈরি করেন। এতে বলা হয়, ‘লকডাউন’ বাস্তবায়ন করতে হলে ১২টি মূলনীতি মানতে হবে।

এসব মূলনীতির মধ্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর বাইরে রয়েছে ঝুঁকিবিষয়ক যোগাযোগ, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, শনাক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে (সঙ্গনিরোধ) নেওয়া, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, খাদ্য ও সামাজিক সহায়তা, শতভাগ নাগরিকের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা, সঠিক চিকিৎসা ও মৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনা এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি।

লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হলে ১২টি মূলনীতি মানতে হবে। যদিও তা হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ‘লকডাউনে’ সফলতার উদাহরণ দেশেই।

বর্তমানে যেসব জেলা ও উপজেলায় ‘লকডাউন’ চলছে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মৌলিক কাজগুলো হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন শুধু ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে দায়িত্ব শেষ করেছে। ফলে ওই সব জেলা-উপজেলায় ‘লকডাউনের’ অবস্থা দাঁড়িয়েছে কার্যত নামকাওয়াস্তে। ‘লকডাউন’ ঘোষিত এলাকার সড়ক, বাজারে জনগণের উপস্থিতি আগের মতোই থাকছে। অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কম ক্ষেত্রে।

সব মিলিয়ে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কিন্তু যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘লকডাউন’ মানে শুধু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু ক্ষেত্রে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করা না। ‘লকডাউন’ কার্যকর করতে হলে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউন’ ঘোষণা হলেও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো (মেডিকেল কমপোনেন্ট) উপেক্ষিত থাকছে। ফলে ‘লকডাউন’ ফলপ্রসূ হচ্ছে না। করোনা রোগীর পরিবারে বাকিদের পরীক্ষা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, শনাক্ত না করে রোগী রেখে দিলে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে।

সাত জেলায় ‘লকডাউন’

সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত ৩০ মে ভারতের সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি। ৩১ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, কোনো এলাকায় সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ হলে স্থানীয় প্রশাসন, সিভিল সার্জন ও জনপ্রতিনিধিরা মিলে পুরো জেলা বা আংশিক এলাকায় ‘লকডাউন’ দিতে পারবেন।

এরপর বেশ কিছু জেলায় স্থানীয় প্রশাসন ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে। ‘লকডাউনের’ বিধিনিষেধ উল্লেখ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। এমন সাতটি জেলায় চলমান লকডাউনের গণবিজ্ঞপ্তির বিধিনিষেধ পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। এসব বিজ্ঞপ্তিতে গণপরিবহন ও বিপণিবিতান বন্ধ, বাজার খোলা রাখার সময়সহ কিছু নির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু নোয়াখালী জেলার বিধিনিষেধের পাশে কারা এটি বাস্তবায়ন করবে, সেটি সুনির্দিষ্ট করে লেখা রয়েছে।

যেসব এলাকার গণবিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করা হয়েছে সেগুলো হলো সাতক্ষীরা জেলা, নাটোর সদর ও সিংড়া পৌরসভা, রাজশাহী সিটি করপোরেশন, নোয়াখালী পৌরসভা ও সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন, নড়াইল সদর পৌরসভার তিনটি এলাকা, নড়াইল সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন ও লোহাগড়া বাজার, জয়পুরহাট সদর ও পাঁচবিবি পৌরসভা এবং যশোর সদর ও অভয়নগর পৌরসভা।

এই সাত জেলায় ৫ জুন করোনা শনাক্ত হয়েছিল ৩৭৯ জনের। গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৭৩২।

স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাজ কম

জয়পুরহাট সদর ও পাঁচবিবি পৌরসভায় ৭ জুন জারি করা বিধিনিষেধের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। গতকাল রোববার ছিল বিধিনিষেধের সপ্তম দিন। বিধিনিষেধের প্রথম দিন জয়পুরহাটে ২২৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৬১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। আর গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়।

জয়পুরহাটে গত সাত দিনে ‘লকডাউন’ চলার সময় মোট ৪৬০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর বিপরীতে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ হাজার ৮৫৮টি। শনাক্তের হার প্রায় ২৫ শতাংশ। জেলায় এ সময় যাঁদের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। জেলায় দরিদ্রদের জন্য খাদ্যসহায়তার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।

জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, নমুনা পরীক্ষার যাঁদের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের করোনা পরীক্ষা করতে বলা হচ্ছে। তবে বাধ্যতামূলকভাবে করানো হচ্ছে না। কেউ এলে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম বলেন, যে বাড়িতে করোনা শনাক্ত হচ্ছে, সে বাড়িগুলো ‘লকডাউন’ করা হচ্ছে। তাঁদের খাদ্যসহায়তার প্রয়োজন হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নম্বর দেওয়া আছে।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১০ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়। তবে রোগীদের সংস্পর্শে আসা মানুষের নমুনা পরীক্ষা ও সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হচ্ছে না। তবে রাজশাহী শহরের পাঁচটি জায়গায় করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য বুথ বসানো হয়েছে। জনগণকে বিনা মূল্যে এসব বুথ থেকে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করতে জেলা প্রশাসন অনুরোধ জানিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীতে ১ হাজার ৫২৬ জনের পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩৬৮ জনের। শনাক্তের হার ২৪ শতাংশের কিছু বেশি।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল প্রথম আলোকে, করোনা শনাক্ত হওয়া সবার কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা কষ্টসাধ্য। যাঁদের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, তাঁদের বলে দেওয়া হচ্ছে তার সংস্পর্শে আসাদের পরীক্ষা করিয়ে নিতে। তিনি বলেন, ‘লকডাউন’ শুরু হয়েছে দুই দিন। তাই এখনো খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়নি। তবে প্রস্তুতি রয়েছে।

নড়াইলে গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৬৭ জনের পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল প্রায় ৫১ শতাংশ। রোগী বাড়তে থাকায় গত শুক্রবার রাতে নড়াইল সদর পৌর এলাকার কিছু অংশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।

নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। যেসব বাড়িতে করোনা রোগী রয়েছেন, সেখানে লাল পতাকা টানানো হয়েছে। রোগীর সংস্পর্শে আসাদের করোনা পরীক্ষা করাতে বলা হয়েছে। জনগণকে মাস্ক ব্যবহার করতে সচেতন করা হচ্ছে।

উদাহরণ দেশেই

‘লকডাউন’ সফলভাবে বাস্তবায়ন করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার উদাহরণ দেশেই রয়েছে। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্তে কথা জানায় সরকার। মাদারীপুরের শিবচরে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ১৪ মার্চ। ১৯ মার্চ শিবচর উপজেলাকে ‘লকডাউন’ করা হয়। রাজধানীর মিরপুরের উত্তর টোলারবাগের দুই বাসিন্দা করোনায় মারা যান গত বছরের ২১ ও ২২ মার্চ। এরপর ২৩ মার্চ টোলারবাগে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়। শিবচর ও টোলারবাগ দুই এলাকাতেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছিল।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টোলারবাগ ও শিবচর এলাকার লকডাউন সফল করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগী ছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় সাংসদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, বাড়ি, ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতিসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও যুক্ত হয়েছিলেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা এলাকায় ব্যাপকভাবে ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ করেছিলেন।

‘লকডাউন’ কার্যকর করার ক্ষেত্রে কৌশলপত্র প্রস্তুতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউন বাস্তবায়ন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার বিষয়। টোলারবাগের উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে।’ তিনি বলেন, সুফল পেতে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ একত্রে কাজ করতে হবে। কিন্তু ‘লকডাউন’ দেওয়া জেলাগুলোয় স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে।