লকডাউন চাঁপাইনবাবগঞ্জে, সংক্রমণ বেশি সীমান্তে

সীমান্তের সাত জেলায় করোনা সংক্রমণ বেশি। স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করার পরামর্শ জনস্বাস্থ্যবিদদের।

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এই সময় জেলায় দোকানপাট বন্ধ থাকার পাশাপাশি আন্তজেলা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকবে। লকডাউন কার্যকর করতে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

দেশের উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী এই জেলায় করোনা সংক্রমণের হার অনেক বেশি। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার গড় হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দুজনের মধ্যে একজনের (৫৯ শতাংশ) করোনা শনাক্ত হচ্ছে। অথচ গত এক সপ্তাহে শনাক্তের জাতীয় হার ছিল ৯ শতাংশের নিচে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়া আরও ছয়টি জেলায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী বলে গত পরশু প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরিন। অন্য জেলার মধ্যে আছে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, রাজশাহী ও সিলেট।

গত এক মাসে প্রতিবেশী দেশ ভারতে সংক্রমণ বৃদ্ধি ও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বৈশ্বিক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে দুই দেশের নাগরিকদের চলাফেরার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন।

চুয়াডাঙ্গা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, গত সাত দিনে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে ৫৪৭ জন বাংলাদেশে এসেছেন। এঁদের নমুনা পরীক্ষায় ১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। গতকাল জেলায় শনাক্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ নেপালের ঘটনা দেখে সতর্ক হতে হবে। ভারত–নেপাল সীমান্তবর্তী এলাকার নেপালি ভূখণ্ডে সম্প্রতি সংক্রমণ অনেক বেশি হয়েছে এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন ঠিকমতো কাজে আসবে না, যদি মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা না যায়। সব মানুষকে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। আম পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মাস্ক পরা ও নিয়মিত হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে হবে।

দৃষ্টি চাঁপাইনবাবগঞ্জে

গতকাল সোমবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জেলায় সাত দিনের লকডাউনের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী হার লক্ষ করা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে করোনা সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশের বেশি। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনাক্রমে সোমবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। জনগণকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখতে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

লকডাউনের সময় সব দোকানপাট ও যান চলাচল বন্ধ থাকবে। রাজশাহী ও নওগাঁ থেকে কোনো যানবাহন চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রবেশ করতে পারবে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেও কোনো যানবাহন জেলার বাইরে যাবে না। রোগী ও অন্য জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।

এখন আমের মৌসুম। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জন্য বিখ্যাত। আমের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক বলেন, আমের বাজার বসবে; তবে সেটা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। আম পরিবহনের ক্ষেত্রে বাগান থেকে আম ট্রাকে করে পরিবহন করা যাবে, সেই সঙ্গে কুরিয়ারের মাধ্যমে আম পরিবহন করা যাবে। কলকারখানা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করতে হবে।

সংবাদ বিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার এ এইচ এম আবদুর রাকিব ও সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুল চৌধুরী।

সিভিল সার্জন প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের পর থেকে সংক্রমণের হার বেড়েছে। সীমান্তে অবৈধভাবে চলাচল করে লোকজন। এতে করে করোনার ভারতীয় ধরন (ভেরিয়েন্ট) ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও ভারতীয় ভেরিয়েন্ট এখনো শনাক্ত হয়নি। আক্রান্ত ৪২ জনের নমুনা বিশ্লেষণের জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।

বিজিবি ৫৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আমির হোসেন মোল্লা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সীমান্তে আমরা টহল জোরদার করেছি। মাইকিং করে সচেতনতা সৃষ্টিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

সীমান্তে সংক্রমণ

ঈদের ছুটির আগে যশোর সীমান্ত দিয়ে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের নমুনা পরীক্ষায় প্রথম করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়।

গতকাল যশোর জেলার সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় সংক্রমণ হার খুব বেড়েছে, তা বলা যাবে না। ঈদের পর থেকে সংক্রমণ হার ১৬–১৭ শতাংশ দেখা যাচ্ছে। সিলেট জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মেঞ্জয় দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ বাড়ছে কি না, তা বুঝতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতাবস্থায় আছে। কোনো দিন বাড়ছে, কোনো দিন হার কমছে।

সাতক্ষীরা জেলার সিভিল সার্জন হোসাইন সাফায়েত প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ঈদের আগের সপ্তাহে সংক্রমণের হার ছিল ১৩ শতাংশ, এখন তা ১৬ শতাংশ। জেলার মানুষকে মাস্ক পরতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বলা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি জেলায় নিজের মতো করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া, আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) বা কোয়ারেন্টিনের (সঙ্গনিরোধ) ব্যবস্থা জেলাগুলো নিজেদের মতো করে করবে। কেউ সহায়তা চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় সেই সহায়তা দেবে।’