লাশ গোসলের সাহসী কাজে তানিয়ারা

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘টিম আলী ইউসুফ’–এর চার নারী সদস্য করোনা রোগীর লাশ গোসল করান।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তানিয়া ইয়াসমীনের মা মারা যান। সে সময় মা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। সেই স্মৃতি সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায় তানিয়াকে। এই করোনায় আবার তিনি মুখোমুখি হলেন প্রায় একই রকম আরেক ঘটনার।

করোনায় মারা যাওয়া আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে গোসল করান তানিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোসল করানোর সময় তাঁর পেটে যখন হাত দিই, তখন মনে হয় আমার সামনে আমার মা শুয়ে আছেন। চোখ দিয়ে আমার অনবরত পানি পড়তে থাকে।’ গত ঈদুল আজহার আগের রাতের ঘটনা এটি। তানিয়া নিজেও দুই সন্তানের মা।

ময়মনসিংহের ডিভিশনাল ব্লাড সোসাইটির উপদেষ্টা আলী ইউসুফের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নাম ‘টিম আলী ইউসুফ’। তানিয়া এই টিমের সদস্য। আরও তিন নারী আছেন লাশ গোসল করানোর এই দলে। তাঁরা হলেন কাব্য সুমি সরকার, রোজি ইয়াসমীন ও তাহমিনা আফরিন।

বিএ পাস তানিয়ার মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের স্কুলে ভর্তির বয়স হয়েছে। টেলিফোনে তিনি বললেন, ‘ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি। সব সময় মনে হয়, ভালো কাজ করলে মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।’

টিম আলী ইউসুফ গত বছর থেকেই করোনা রোগীদের জন্য কাজ করছে। এই টিমের স্বেচ্ছাসেবকেরা রোগীদের অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের কাজও করছেন। তবে নারীদের মৃতদেহের গোসলের জন্য চার নারীর দলটি গঠন করা হয় চলতি মাসে।

কাব্য সুমি সরকার ময়মনসিংহ ডিভিশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। ডিভিশনাল ব্লাড সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাব্য সুমি ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাহিত্য পরিষদেরও সভাপতি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৫২টি পরিবারসহ দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করেন তিনি। করোনায় মারা যাওয়া প্রথম যাঁকে গোসল করান কাব্য সুমি, সেই ২১ বছরের তরুণীও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। কাব্য বললেন, ‘আগে আত্মীয় মারা গেলেও লাশ দেখিনি। ভিতু ছিলাম। আর এখন মনে হয় এত দিন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করলেও এখন যেন কাজ আর আত্মা এক হয়েছে।’

দলের আরেক সদস্য রোজি ইয়াসমীন। তিনি আলী ইউসুফের বোন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট মেয়ে পড়ছে দশম শ্রেণিতে। রোজি বললেন, ‘একদিন না একদিন তো সবাইকে মরতে হবে। ভয় পেয়ে লাভ নেই।’

নারী স্বেচ্ছাসেবক দলের আরেক সদস্য এইচএসসির শিক্ষার্থী তাহমিনা আফরিন। বয়স কম বলে এ কাজে তাঁকে নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে তাহমিনা দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। তবে আলী ইউসুফকে বোঝাতে সক্ষম হন যে অন্যরা করতে পারলে তিনিও পারবেন। বাসা থেকেও আর বাধা আসেনি।

প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জগলুল পাশা জানিয়েছেন, আলী ইউসুফ ছাপাখানার ব্যবসার পাশাপাশি রক্তদানসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত। তাঁর দলে ৪ জন নারী আর ১০ জন পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। আলী ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরাই বললেন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সরাসরি কিছু করতে চান। সেখান থেকে নিজের বোনসহ চারজনকে নিয়ে নারী দলটি গঠন করি।’ তিনি জানান, অনেকে তাঁর স্বেচ্ছাসেবী কাজের জন্য অ্যাম্বুলেন্স, পিপিইসহ বিভিন্ন জিনিস দান করছেন।