সংক্রমণের সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও

পরিস্থিতির অনেক অবনতি হলে করোনা রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অধিকাংশ মৃত্যু হয় ভর্তির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে।

রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ফুটপাতে কেনাকাটায় ব্যস্ত মানুষ। ভিড়ের মধ্যেও কারও মুখে নেই মাস্ক
ছবি: প্রথম আলো

করোনায় সংক্রমণের সঙ্গে মৃত্যু বাড়ছে। গতকাল শনিবার ছয়জনের মৃত্যুসংবাদ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগের দিন মৃত্যু হয়েছিল পাঁচজনের। জুলাইয়ে প্রথম ২ দিনে ১১ জন মারা গেলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।

গত মাসে অর্থাৎ জুনে করোনায় দেশে ১৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে সাতজন পূর্ণ দুই ডোজ টিকা নিয়েছিলেন। পাঁচজন তিন ডোজ বা বুস্টার ডোজ নিয়েছিলেন। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জন কোনো টিকা নেননি। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তিদের মধে৵ ৬৭ শতাংশ টিকা নিয়েছিলেন। টিকা নেননি ৩৩ শতাংশ। এই পর্যালোচনাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।

কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন শনাক্তের হারও বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৮ হাজার ১৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। আগের দিন এই হার ছিল ১৫ দশমিক ৩১।

টিকা নিলে মৃত্যু হবে না—বিষয়টি ঠিক এমন নয়। টিকা মৃত্যুঝুঁকি কমায়। বয়স যাঁদের বেশি, তাঁদের মধ্যে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।
এ এস এম আলমগীর, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সদ্য সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সদ্য সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, টিকা নিলে মৃত্যু হবে না—বিষয়টি ঠিক এমন নয়। টিকা মৃত্যুঝুঁকি কমায়। বয়স যাঁদের বেশি, তাঁদের মধ্যে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। বেশি বয়সীরা ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও কিডনি রোগে বেশি ভোগেন। এসব রোগে ভোগা ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়ে, তাঁদের ঝুঁকি বেশি।

কোন বয়সী মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি সেই তথ্যও পাওয়া যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছ থেকে। কোন বয়সী মানুষের মৃত্যু বেশি হচ্ছে, তা জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ০–১০, ১১–২১, ৩১–৪০ এভাবে ৯১–১০০ এবং ১০০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষকে মোট ১১টি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। তাতে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ৬১ বছর থেকে ৭০ বছর বয়সসীমায় থাকা মানুষের। এ পর্যন্ত ওই বয়সী ৯ হাজার ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশ।

দেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে ষাটোর্ধ জনসংখ্যার হার ৭ শতাংশ। অথচ মোট মৃত্যুর ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ ঘটেছে এই বয়সীদের মধ্যে। পরিসংখ্যান বলছে, শিশুদেরও মৃত্যুঝুঁকি আছে। করোনায় এ পর্যন্ত ৮৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের বয়স ১০ বছর বা তার কম। অন্যদিকে ১০০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এই মহামারিতে।

দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ। সেই থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে ২৯ হাজার ১৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ১৮ হাজার ৬১৩ জন বা ৬৪ শতাংশ এবং নারী ১০ হাজার ৫৪৭ জন বা ৩৬ শতাংশ। করোনা সংক্রমণ বা মৃত্যু নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি কেন, তার সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এটি একটি বৈশ্বিক প্রবণতা।

করোনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ সেবা নিয়েছে সরকারি হাসপাতালে। স্বাভাবিক কারণে মৃত্যুও সরকারি হাসপাতালে বেশি হয়েছে। তবে অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হননি বা হতে পারেননি অথবা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়নি, এমন ৭৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বাড়িতে। হাসপাতালে নয়, বাড়িতেও নয়—এমন মৃত্যুর খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। অর্থাৎ তাঁদের মৃত্যু হয়েছে রাস্তায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, যাঁদের হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে, এমন মৃত্যুর সংখ্যা ৩৫।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল জুলাইয়ে। ওই মাসে ১ হাজার ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২১ সালেও সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল জুলাইয়ে। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ১৮২। অন্যদিকে এক দিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল ২০২১ সালের ৫ আগস্ট। ওই দিন ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করছেন, এ বছর জুলাইয়ে অর্থাৎ চলতি মাসে পরিস্থিতি আগের দুই জুলাই মাসের মতো খারাপ হবে না। কারণ, দেশের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ টিকা নিয়েছে। গত বছর মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছিল করোনাভাইরাসের ডেলটা ধরনে। মানুষ এখন আক্রান্ত হচ্ছে অমিক্রন ধরনে। ডেলটার তুলনায় অমিক্রন কমজোরি। অর্থাৎ মানুষ আক্রান্ত হলেও রোগের উপসর্গ তীব্র নয়।

তবে কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। সজাগ ও সচেতন থাকলে এখন যে মৃত্যু হচ্ছে, তা–ও কমানো সম্ভব। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনায় মৃত্যুর পর্যালোচনায় গবেষকেরা দেখেছেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অধিকাংশ মৃত্যু ঘটছে। এর কারণ, মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অনেক পরে, শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে হাসপাতালে আসে। পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হওয়ার আগে করোনা রোগীকে হাসপাতালে আনলে আরও কিছু মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।

ওই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক রুবিনা ইয়াসমিন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও কিডনি রোগে ভুগছেন, এমন ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, হাসপাতালে ভর্তি করার উদ্যোগ নিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আগে হাসপাতালে নিলে কিছু মৃত্যু কম হবে। তবে বেশি জোর দেওয়া উচিত মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর, যেন সংক্রমণ এড়ানো যায়।