১৫ মাস পর মহামারি নিয়ন্ত্রণে মানুষকে যুক্ত করার উদ্যোগ

ঠিক সময়ে সঠিক তথ্যে মানুষের আস্থা বাড়ে। কিন্তু মহামারি নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকে মানুষকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ।

দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কত দূর গড়ায়, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা প্রায় সমানভাবে চিন্তিত। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ‘ঝুঁকি যোগাযোগ ও জনসম্পৃক্ততা’র কৌশলপত্র তৈরি করছে। ১৫ মাস আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই কৌশলপত্র তৈরির পরামর্শ দিয়েছিল।

২০২০ সালের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, করোনার স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানা ও বোঝার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। মহামারি মোকাবিলার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়াও মানুষের অধিকার। সঠিক তথ্য বিভ্রান্তি এড়াতে ও ভুল-বোঝাবুঝি দূর করতে সহায়তা করে। মানুষকে কোন সময় কী তথ্য, কী বার্তা দিতে হবে এবং মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কীভাবে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে, তা-ও বলে দিয়েছিল সংস্থাটি। সংস্থাটি বলেছিল, মহামারি মোকাবিলা প্রস্তুতি ও কর্মপরিকল্পনার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ঝুঁকি যোগাযোগ ও জনসম্পৃক্তকরণ। ২৬ পৃষ্ঠার নির্দেশনায় কৌশলপত্র তৈরির প্রক্রিয়া কী হবে, তা-ও বলে দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি কৌশলগত কার্যকর পদক্ষেপের একটি খসড়া তৈরি করেছে। গত সপ্তাহে ছোট পরিসরে খসড়া নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে এই কৌশলপত্রের খসড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে তা যাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাবে। তারপর তা চূড়ান্ত হবে। চূড়ান্ত হওয়ার পর করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কবে নাগাদ ওই কৌশলপত্র কাজে লাগানো হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।

কর্তৃপক্ষের ওপর মানুষের আস্থা কম, তাই কর্তৃপক্ষের বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন বার্তা-উপদেশ মানুষ কানে নিচ্ছেন না।
অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম ৯ সদস্যের কমিটির প্রধান। গতকাল শুক্রবার নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একটি কর্মপরিকল্পনার খসড়া তৈরি হয়েছে। তাতে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বিস্তারিত জানার জন্য তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, কাজ চলছে। স্থানীয় পর্যায়ে মাইকিং করে, মসজিদের মাধ্যমে মানুষকে তথ্য দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ছাড়াও দেশের সব সংবাদপত্র ও বেসরকারি টেলিভিশন মানুষকে তথ্য দেওয়ার কাজ করছে। বেসরকারি সংস্থা হাঙ্গার প্রজেক্ট ১ হাজার ২০০ গ্রামে কাজ করছে। সরকারের পক্ষে ৩৫ জেলায় কাজ করছে ব্র্যাক, ৬টি জেলায় সরকারকে সহযোগিতা করছে সেভ দ্য চিলড্রেন। তিনি বলেন, ‘তারপরও দেখা যাচ্ছে মানুষের আচরণ পরিবর্তন হচ্ছে না। মানুষ মাস্ক পরছেন না, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। এখন সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা সক্রিয়ভাবে ভাবা হচ্ছে।’

মহামারি পরিস্থিতি

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ নিয়মিতভাবে বাড়তে থাকে। সংক্রমণ শীর্ষে পৌঁছায় আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে। এরপর থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে।

সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অনেকেই বলেছিলেন, শীতকালে সংক্রমণ বাড়বে, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হবে। বাস্তবে তা হয়নি। সংক্রমণ বাড়তে থাকে এ বছরের মার্চের শুরু থেকে। সংক্রমণ শীর্ষে পৌঁছায় এপ্রিলের মাঝামাঝি। তারপর থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে।

গত ঈদের পর থেকে আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এবার সংক্রমণ প্রথম দেশের সীমান্তবর্তী জেলায় বাড়তে দেখা যায়। এখন দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। এরই মধ্যে দেশে করোনার ‘ডেলটা ভেরিয়েন্ট’ শনাক্ত হয়েছে ৭ মে। অনেকে ধারণা করেন, অতি সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার ব্যাপক সংক্রমণ ও মৃত্যুর পেছনে আছে করোনার ডেলটা ধরন (ভারতে শনাক্ত)। দুই দিন আগে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একজন বিজ্ঞানী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা শহরে এখন ডেলটা ভেরিয়েন্টেরও সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে।

দেশে টিকাদান পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে এ পর্যন্ত ৪৩ লাখ মানুষও পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পাননি। খুব শিগগির দেশের সিংহভাগ মানুষের টিকার আওতায় আসার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এই পরিস্থিতিতে মানুষের সচেতন আচরণের কোনো বিকল্প নেই।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষকে সঠিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয়েছেন। মানুষকে ঠিক সময়ে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। বরং মাঝেমধ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের ওপর মানুষের আস্থা কম, তাই কর্তৃপক্ষের বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন বার্তা-উপদেশ মানুষ কানে নিচ্ছেন না।’

খসড়ায় কী আছে

‘ঝুঁকি যোগাযোগ ও জনসম্পৃক্ততা’র কৌশলপত্রের খসড়ায় ১২টি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় ব্যবসায়ী, সামাজিক নেতা, গণমাধ্যম, পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠন, ইমাম, মাদ্রাসা শিক্ষক অ্যাসোসিয়েশন, চিকিৎসক সংগঠন, নারী সংগঠনকে মাস্ক পরায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে সম্পৃক্ত করতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে চাহিদাপত্র (ডিও) পাঠাবেন বলে প্রস্তাব করা হয়েছে।

করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও ধর্ম মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে স্বপ্রণোদিত হয়ে সক্রিয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সরকার এখন যেসব কাজ বাস্তবায়ন করছে, তাতে যেখানে সম্ভব স্বেচ্ছাসেবক ও এনজিও কর্মীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ওষুধের দোকানদার, কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, কবিরাজদেরও সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজে যোগ দিতে বলতে হবে। এঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

খসড়া কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার ব্যাপারে নিয়মিত মাইকে প্রচার করার পাশাপাশি পোস্টার লাগাতে হবে, প্রচারপত্র বিতরণ করতে হবে, স্থানীয় গণমাধ্যম ব্যবহার করতে হবে।

মুঠোফোন সেবা বা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে মানুষের মানসিক চাপ, ভয়ভীতি, দুশ্চিন্তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সব দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে হবে। কোন কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার বা কোন প্রতিষ্ঠানের, কিছু ক্ষেত্রে তার উল্লেখ আছে।

এই খসড়া তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমরা সব স্তরের জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে মহামারি মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করার কথা বলেছি। মানুষের সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।’