১% কোভিড রোগী সুস্থ হয়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত

করোনায় আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ডায়াবেটিক। কোভিড-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ডায়াবেটিকদের মধ্যেই বেশি।

প্রতীকী ছবি
রয়টার্স

চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়ার পর প্রতি ১০০ জনে একজন (১ শতাংশ) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার করোনায় আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন আগে থেকেই ডায়াবেটিস রোগী। আবার কোভিড-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে। এ ছাড়া কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ডায়াবেটিস রোগীরা একাধিক রোগ ও শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রবন্ধটি ১৫ অক্টোবর প্রকাশনার জন্য গৃহীত হয় আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ারের ‘ডায়াবেটিস অ্যান্ড মেটাবলিক সিনড্রোম: ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউস’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে। গত এপ্রিল থেকে জুন মাসে চট্টগ্রামের চারটি কোভিড হাসপাতালের ৭৩৫ জন করোনা রোগীর ওপর এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এই রোগীদের ৭৬ শতাংশ পুরুষ।

কোভিডে আক্রান্ত রোগীর দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। ডায়াবেটিস রোগীর যেকোনো সংক্রমণ হলে স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়। ফলে রক্তে গ্লুকোজ বৃদ্ধি পায় ও স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। একইভাবে সংক্রমণের জটিলতার কারণে ইনসুলিনও অল্পমাত্রায় ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
আদনান মান্নান, গবেষণা দলের প্রধান

গবেষণায় দেখা গেছে, আগে যাঁদের অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, হদ্‌রোগসহ বিভিন্ন জটিলতা ছিল, তাঁরা করোনা জয় করার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই বয়স ৩০ থেকে ৪০–এর মধ্যে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে প্রতি পাঁচজন করোনা রোগীর মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ফারহানা আক্তার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক আদনান মান্নান। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, আবদুর রব, বিআইটিআইডির অণুজীববিজ্ঞানী শাকিল আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুব হাসান, গবেষণা শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসেন মিয়াজি।

গবেষণায় আরও বলা হয়, রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোভিডে আক্রান্ত ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীকেই ইনসুলিনের মাত্রা তিন গুণ বাড়াতে হয়। কোভিডে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীদের উপসর্গ হিসেবে জ্বর, ৬০ শতাংশের কফ ও কাশি এবং ৪৫ শতাংশের শারীরিক ব্যথা অনুভূত হয়েছে। ৬০ শতাংশের বেশি রোগীর রক্তে ফেরিটিন ও ডি ডাইমারের পরিমাণ অধিকমাত্রায় পাওয়া গেছে। মোটা দাগে ৯৭ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সময় কোনো না কোনো উপসর্গ ছিল। অবশ্য তাঁদের অর্ধেকেরও বেশি রোগীর একাধিক উপসর্গ দেখা যায়। মূলত, কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার চার সপ্তাহ পর চট্টগ্রামের রোগীদের কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

• দেশে ডায়াবেটিস রোগী ৯০ লাখ

• চট্টগ্রামে প্রায় ১০ লাখ

• চট্টগ্রামে কোভিড রোগী ২০,২৭৭

• মারা গেছেন ৩০১ জন

• সুস্থ হয়েছেন ১৫,৮৩৬ জন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর চট্টগ্রামে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখের মতো। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত কোভিডে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ২৭৭। মারা গেছেন ৩০১ জন। সুস্থ হয়েছেন ১৫ হাজার ৮৩৬ জন।

আন্তর্জাতিক গবেষণার চিত্র

শুধু চট্টগ্রামে নয়, কোভিড থেকে সেরে ওঠার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন–এ সম্প্রতি এক গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালি ও সিঙ্গাপুরে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ রোগী করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে কোভিডে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ, ইতালিতে ১৭, যুক্তরাষ্ট্রে ১১, স্পেনে ১০ ও চীনে ১০ শতাংশ করোনা রোগীর আগে ডায়াবেটিস ছিল।

গবেষণা দলের প্রধান আদনান মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডে আক্রান্ত রোগীর দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। ডায়াবেটিস রোগীর যেকোনো সংক্রমণ হলে স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়। ফলে রক্তে গ্লুকোজ বৃদ্ধি পায় ও স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। একইভাবে সংক্রমণের জটিলতার কারণে ইনসুলিনও অল্পমাত্রায় ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।

গবেষণা দলের ক্লিনিক্যাল প্রধান ফারহানা আক্তার বলেন, করোনার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের বয়স ৩০-এর ঊর্ধ্বে। মূলত, কোভিডের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের সতর্ক থাকতে হবে।