করোনায় গড়া হাত ধোয়ার অভ্যাস ভুলে যাচ্ছে মানুষ

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ভবনে এখন আর হাত ধোয়ার স্থাপনা নেই। সাবান বা জীবাণুমুক্ত করার সামগ্রীর চাহিদা কমে গেছে।

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর ঢাকা ওয়াসা ভবনে ঢোকার বাঁ পাশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পরপরই হাত ধোয়ার একটি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল। পা দিয়ে চালিয়ে এতে হাত ধোয়া যেত। গত বৃহস্পতিবার ভবনে গিয়ে সেই স্থাপনা দেখা গেল না। প্রায় এক বছর হলো সেটি তুলে ফেলা হয়েছে বলে কর্মচারীরা জানালেন। কর্মচারী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা তো এহন নাই। এহন আর হাত ধোয়ারও দরকার হয় না। এইটা রাইখ্যা কী হবে, তাই তুইল্যা ফালাইছে।’

ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক বলেন, স্থাপনাটি আরও উন্নতভাবে তৈরি করা হচ্ছে। এরপর সেটি আবার বসানো হবে।

করোনা তো এহন নাই। এহন আর হাত ধোয়ারও দরকার হয় না। এইটা রাইখ্যা কী হবে, তাই তুইল্যা ফালাইছে।
কর্মচারী রফিকুল ইসলাম

রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে করোনাকালে হাত ধোয়া বা জীবাণুমুক্ত করাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। দেশে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছিল। এ সময় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হাত ধোয়ার স্থাপনা তৈরি করে। স্থাপনাগুলোতে সাবান বা হাত জীবাণুমুক্ত করার সামগ্রী রাখা হয়েছিল। কিন্তু সংক্রমণ কমে আসায় হাত ধোয়া বা জীবাণুমুক্ত করার স্থাপনা অব্যবহৃত পড়ে আছে বা নষ্ট হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

করোনা সংক্রমণ থাকলেও মানুষের হাত ধোয়ার আগ্রহ কমে গেছে, এমন এক অবস্থায় আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘হাতের পরিচ্ছন্নতায় এসো সবাই এক হই’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ গত বছর যৌথ এক প্রতিবেদনে বলেছে, হাত ধোয়ায় লাভ তিনটি। এগুলো হচ্ছে এটি জীবন বাঁচায়, অর্থের অপচয় কমায় ও ভবিষ্যতের সংক্রামক রোগ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেয়। করোনাকালে হাত ধোয়ার সুঅভ্যাস মানুষ নিয়মিত চর্চা করলে এসব লাভ অর্জন হতো। কিন্তু বাস্তবে এই সুঅভ্যাস কমে গেছে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সংক্রমণের ভয়ে মানুষ হাত ধোয়ার অভ্যাসটা ভালোই রপ্ত করেছিল। কিন্তু বিপদ কিছুটা কেটে যাওয়ায় এই অভ্যাস কমে গেছে। বিভিন্ন ভবনে হাত ধোয়ার স্থাপনা এখন অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর তেজতুরী বাজারে ঢাকা উত্তর সিটির সহযোগিতায় হাত ধোয়ার একটি স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল। সেটি এখন আর নেই। স্থাপনাটির পাশে থাকা একটি মুদিদোকানের মালিক

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, তাঁর দপ্তর থেকে হাত ধোয়ার নানা সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী তা দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে হ্যান্ড ওয়াশসহ হাত ধোয়ার সামগ্রীর চাহিদা কমে যাচ্ছে।

হাত না ধোয়ার ফলে বাংলাদেশের মানুষের নানা অসুখ হয়। দেশে গত কয়েক দশকে ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেলেও এখনো দেশের পাঁচ বছর বয়সী এক হাজার শিশুর মধ্যে সর্বোচ্চ ছয়জনের মৃত্যু হয় এই রোগে। শ্বাসজনিত সংক্রমণ বাংলাদেশে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। ডায়রিয়া ও শ্বাসজনিত রোগের সংক্রমণে হাতের দূষণ মূল ভূমিকা রাখে বলে স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন।

‘ইফেক্ট অব ওয়াশিং হ্যান্ডস উইদ সোপ অন ডায়রিয়া রিস্ক ইন দ্য কমিউনিটি: এ সিস্টেমেটিক রিভিউ’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, সাবান দিয়ে হাত ধুলে শিশুদের ডায়রিয়া থেকে সুরক্ষা দেয় ৩০ থেকে ৪৭ শতাংশ। আর শ্বাসজনিত রোগের ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেয় ২৩ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার বাংলাদেশের বিপণনে হাত ধোয়ার অভ্যাস কমার একটি চিত্র পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির করপোরেট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক শামীমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে তরল সাবানের ব্যবহার ১০ শতাংশ বেড়েছিল। গত বছর এর বিক্রি প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। আবার গত বছরের তুলনায় এ বছর চাহিদা কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, করোনার মতো সংক্রমণ প্রতিরোধে শুধু নয়, স্বাস্থ্যের আরও নানা ঝুঁকি নিরসনে হাত ধোয়ার গুরুত্ব ব্যাপক। করোনাকালে গড়ে ওঠা এই অভ্যাস তাই ধরে রাখতে হবে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগও লাগবে।