মহামারি নিয়ন্ত্রণ
করোনার টিকাদানে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ
চারটি উৎস থেকে পর্যাপ্ত করোনার টিকা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গত মাসে দেশে চতুর্থ ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ গত বছর করোনা টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছে। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনা টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচ বছরের বেশি বয়সী ৯৬ শতাংশ মানুষ করোনার টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছে, বুস্টার ডোজ পেয়েছে ৮২ শতাংশ মানুষ। প্রতিবেশী কোনো দেশ এই হারে তাদের নাগরিকদের টিকার আওতায় আনতে পারেনি। দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিও অনেকটা সন্তোষজনক।
২০২২ সাল শেষ হওয়ার আগেই করোনার টিকার চতুর্থ ডোজ বা দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২০ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ পেয়েছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে করোনার টিকাদান কর্মসূচির শুরুতে মানুষের মধ্যে নানা সংশয় ও উদ্বেগ ছিল।
দেশের সব মানুষের জন্য টিকা সংগ্রহ করা যাবে কি না, সংগ্রহ করা গেলেও অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে টিকার আওতায় আনা যাবে কি না—এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। বাংলাদেশ দুটি ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। টিকা কেনা, বিতরণ ও প্রয়োগে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সরাসরি বিদেশি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টিকা কিনেছে। করোনা টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের কাছ থেকে কিছু টিকা অনুদান হিসেবে পেয়েছে। আবার কিছু টিকা বন্ধুদেশগুলোর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া গেছে। বাকি টিকা কোভ্যাক্সের মধ্যস্থতায় ভর্তুকি মূল্যে কেনা হয়েছে। এই চার উৎস থেকে সংগ্রহ করা টিকার পরিমাণ ৩৫ কোটি ৯৪ লাখ ৭৯ হাজার ডোজ। এর মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা রয়েছে।
শিশুদের টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। ১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) অভিজ্ঞতা করোনার টিকাদানে কাজে লাগিয়েছে সরকার। ইপিআইয়ের জন্য সারা দেশে এক লাখের বেশি নিয়মিত টিকাকেন্দ্র আছে। করোনার টিকাদানে এসব কেন্দ্র কাজে লেগেছে।
প্রান্তিক বা দুর্গম এলাকার মানুষকে টিকা দিতে একাধিক বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। সুন্দরবনের দুবলার চরে জেলেদের টিকা দেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাপনায়। দেশের পার্বত্য এলাকায় টিকা ও স্বাস্থ্যকর্মী আনা-নেওয়ায় সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে। আবার অল্প সময়ে বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা হয়। এক দিনে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার উদাহরণ তৈরি করেছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করেন, করোনার টিকার সাফল্যের পেছনে আছে নীতি ও পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জাতীয় টিকা প্রয়োগ কমিটি করা হয়েছিল। পাশাপাশি মুখ্য সচিবকে সভাপতি করে একটি জাতীয় কমিটিও কাজ করেছিল।
করোনার টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্যসচিব মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা করোনার টিকাদানে সাফল্য দেখিয়েছি। এতে স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে।’
জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ মনে করে, করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে টিকার সাফল্যের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে এখন সংক্রমণের হার ও করোনায় মৃত্যু তুলনামূলক কম। বিশ্বের শীর্ষ জনঘনত্বের দেশ হওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লাখ ৩৭ হাজারের কিছু বেশি মানুষ। মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪৪০ জন।
দেশে মহামারি মোকাবিলায় সক্ষমতা বেড়েছে। ২০২০ সালে মহামারির শুরুতে দেশে রোগ পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল মাত্র একটি। তিন বছর পর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৮৩। হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বেড়েছে, অক্সিজেন সরবরাহ বেড়েছে কয়েক গুণ।
তবে বছরের প্রথম দিন গতকাল রোববার রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, দেশে করোনার অমিক্রন ধরনের উপধরন বিএফ.৭ শনাক্ত হয়েছে। উদ্বেগের কারণ, এই ধরন অতি দ্রুত ছড়ায়।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মাস্ক পরলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, মাঝেমধ্যে সাবান দিয়ে হাত ধুলে বিএফ.৭-এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।