জরুরি অবস্থা তুলে নিল ডব্লিউএইচও, কী করবে বাংলাদেশ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যগত বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর বৈঠক করেছে দেশের করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কমিটি মনে করছে, করোনাকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যেসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো অটুট রাখতে হবে

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের অংশ হিসেবে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেইজিং থেকে আসা একজন যাত্রীকে পরীক্ষা করা হচ্ছে
ফাইল ছবি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জারি করা স্বাস্থ্যগত বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর এখন বাংলাদেশ এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করছে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলমান করোনা মহামারি থেকে নেওয়া শিক্ষা কাজে লাগাতে চায় সরকার; যাতে ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলা সহজ হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণার পরদিন গত শনিবার করণীয় নিয়ে বৈঠক করেছে করোনা মোকাবিলায় সরকারের গঠন করা করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
কারিগরি কমিটির সদস্যরা মনে করছেন, করোনাকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে বা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো অটুট রাখতে হবে। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলা যেন সহজ হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থাগুলো টিকিয়ে রাখা দরকার বলে মনে করছেন তাঁরা।

বৈঠকের বিষয়ে কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা বিষয়ে স্বাস্থ্যবিধি ইতিমধ্যে শিথিল হয়ে গেছে। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ সিদ্ধান্তের পর আমরা মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতো বিষয়ে বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছি। তবে হাসপাতালে ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে মাস্ক পরার সুপারিশ করেছি। এর পেছনে বায়ু দূষণও একটি কারণ।’

চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ৪০ দিন পর ১১ মার্চ করোনাকে মহামারি ঘোষণা করে সংস্থাটি। এর আগে ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। আর করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ওই মাসের ১৮ তারিখে।

৭৬
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭৬ কোটি ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন ৬৯ লাখের বেশি মানুষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৭৬ কোটি ছাড়িয়েছে। মারা গেছেন ৬৯ লাখের বেশি মানুষ।  
গতকাল করোনা-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ পর্যন্ত দেশে ২০ লাখ ৩৮ হাজার ৩৩৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৪৪৬ জনের।

করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে সরকার মাস্ক পরার পাশাপাশি সমাবেশ বন্ধ এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতো স্বাস্থ্যবিধি জারি করে। এরপর কয়েক দফায় দেশজুড়ে চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
করোনার সংক্রমণের হার এবং মৃত্যু কমে আসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থা তুলে নিয়েছে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশেও করোনা শনাক্তের হার ১-এর নিচে থাকছে দীর্ঘদিন ধরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ৩ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে করোনায় কারও মৃত্যু হয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে বিভিন্ন দেশের জন্য একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্যে আছে করোনাকালে স্বাস্থ্য বিষয়ের অর্জনগুলো ধরে রাখা; যাতে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। করোনার টিকাকে জাতীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি করোনা-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ চালু রাখার কথাও বলেছে তারা। আর করোনা-সংক্রান্ত তথ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সরবরাহ করার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের সংস্থাটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্তের পর আমরা মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতো বিষয়ে বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছি। তবে হাসপাতালে ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে মাস্ক পরার সুপারিশ করেছি
অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা, সভাপতি, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশ দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ও মঙ্গলজনক সিদ্ধান্ত নেবে। অধিদপ্তর আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে থেকে ফল পাওয়া গেছে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে। এক. মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। দুই. টিকাদানে সাফল্য।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নতুন অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে কিছু আছে স্থায়ী, কিছু অস্থায়ী। এগুলোকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে চায় সরকার; যাতে ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলা সহজ হয়। এটা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থেই করতে হচ্ছে।’

করোনার সংক্রমণের শুরুতে অক্সিজেন সরবরাহ, আইসিইউর ঘাটতি ছিল। পরে এসবের সংখ্যা বাড়ানো হয়। করোনা পরীক্ষার জন্য নতুন নতুন কেন্দ্র করা হয়। কোয়ারেন্টিনের (সঙ্গনিরোধ) জন্য জায়গা বরাদ্দ নেওয়া হয়। স্বাস্থ্যগত এমন ব্যবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে এগোনো যায়, তা নিয়ে দ্রুতই সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হবে জানান অধ্যাপক নাজমুল।

নতুন উদ্যোগ

বিশ্ব করোনা থেকে মুক্তির পথে থাকলেও নতুন করে যে কোনো মহামারি আসবে না, তা কেউ বলতে পারে না। করোনার কিছু আগেও ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু এবং ২০১২ সালে মার্সের সংক্রমণ ঘটে। তাই মহামারি থেকে যাতে ভবিষ্যতে সুরক্ষা পাওয়া যায়, সে জন্য একাধিক বৈশ্বিক উদ্যোগ আছে। সেগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশও যুক্ত আছে বলে জানান সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।

অধিদপ্তর আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে
অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র

বৈশ্বিক তিনটি উদ্যোগের প্রথমটি হলো মহামারি নিয়ে একটি বৈশ্বিক চুক্তি। এর খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। এ বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে এ নিয়ে আলোচনা হবে। আগামী বছরের মধ্যে চুক্তিটি হয়ে যেতে পারে।

দ্বিতীয় উদ্যোগটি হলো, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি যুগোপযোগী করা। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মহামারির খবর যারা প্রথম প্রকাশ করবে, তাদের শাস্তি না দিয়ে উৎসাহিত করা দরকার।  সাধারণত দেখা যায়, যখনই কোনো দেশ মহামারির খবর প্রকাশ করে, সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশের সঙ্গে আকাশপথ বা যেকোনো পথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কখনো কখনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়ে দেশগুলো। সেই পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, সে জন্য স্বাস্থ্যবিধি যুগোপযোগী করা হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে বিভিন্ন দেশের জন্য একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে করণীয় ঠিক করবে

তৃতীয় উদ্যোগটি হলো, মহামারি নিয়ে একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠন। জি-২০ভুক্ত দেশগুলো এতে সহায়তা করবে। বিশ্বব্যাংক এর সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে। এই তহবিলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো আবেদন করতে পারবে।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে এসব কাজ করছে বাংলাদেশ। সেগুলো হলো নজরদারি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, ল্যাবরেটরি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং স্বাস্থ্য জনবল নিশ্চিত করা। এসব কাজে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক গুরুত্ব দিতে হবে।